ছোট ছোট ভূকম্পনে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা

প্রকাশিতঃ 12:11 pm | January 08, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

সপ্তাহ না ঘুরতেই আবার ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ। মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কম্পনের উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৬১৮ কিলোমিটার দূরে চীনের জিজাং। এর আগে গত শুক্রবারের ৫ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৮২ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের হোমালিন।

এক সপ্তাহে দেশে দুবার ভূমিকম্প অনুভূত হলেও উৎপত্তিস্থল দূরে হওয়ায় বাংলাদেশে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে এ পটভূমিতে মানুষের মনে ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ও পূর্বাভাস ঘিরে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ছোট ছোট এই ভূমিকম্পে বড় বিপর্যয়ের আভাস দেখতে পাচ্ছেন। অবিলম্বে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ তাদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট লাইনসহ টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে আছে। ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছে। ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে পাঁচটি বড় ভূমিকম্প রিখটার স্কেলে ৭-এর ওপরে। এর পর থেকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প স্তিমিত হয়ে আসছে। ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের আগে এই নীরবতা থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ছোট ছোট ভূমিকম্পের পরই বড় ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা আছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্প উদ্বেগজনক হারে বাড়তে দেখা গেছে। ২০২৪ সাল থেকে রেকর্ড করা ৬০ ভূমিকম্পের মধ্যে তিনটি ৪ মাত্রার ওপরে এবং ৩১টি ৩ থেকে ৪ মাত্রার মধ্যে ছিল। নেপাল, ভারত, ভুটান, চীনেও যে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, তা দুর্যোগের আন্তঃদেশীয় মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের এমন শঙ্কার পরও ভূমিকম্প হলে কিছুদিন এ নিয়ে থাকে আলোচনা। তবে ঝুঁকি মোকাবিলায় নেওয়া হয় না কার্যকর উদ্যোগ। ঢাকায় ছয় লাখ ভবনের ৬৬ শতাংশই নিয়ম মেনে হয়নি, নতুন ভবনগুলোতেও উপেক্ষিত নীতিমালা। দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বিল্ডিং কোড। ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাও লেজেগোবরে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে ঘূর্ণিঝড় গবেষণা কেন্দ্র। যন্ত্রপাতি থাকলেও ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে পড়ছে। দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য জরুরি পরিচালন কেন্দ্র তৈরি হলেও জনবল নিয়োগ হয়নি। ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের পর ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। পরে চীনের সহায়তায় ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটির কাজ এখনও শেষ হয়নি।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা বিভিন্ন সময় তৈরি হলেও সেগুলো অপসারণের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় না। এটি অনেকটাই চিঠি চালাচালিতে সীমাবদ্ধ। ৩ হাজার ২০০ ভবন চিহ্নিত করেই থেমে আছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে ভবন নির্মাণের সময় সংস্থাটিকে তদারকি করতে দেখা যায় না। তিলোত্তমা এ নগরীতে লাখ লাখ ভাড়াটিয়া জানেনই না, তারা যেখানে বাস করছেন, তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ!

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ১৮৬৯ সালে সিলেটের কাছার এলাকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ও ১৯২৩ সালে দুর্গাপুরেও বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ফলে সেখানে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা সুপ্ত অবস্থায় আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প সেটিকে নাড়াচাড়া দিতে পারে। সম্প্রতি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি; মানে এই নয় যে আর বড় ভূমিকম্প হবে না। তাই এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। ৭ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প একশ থেকে দেড়শ বছর পরপর হতে পারে। সে হিসাবে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে যে কোনো সময় হওয়ার শঙ্কা আছে। ঢাকা শহরের ২৫ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি হয়নি।

গত জুনে ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট: রাজউক অংশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৮৮৫ সালে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল টাঙ্গাইলের মধুপুরের ভূগর্ভের চ্যুতি বা ফাটল রেখায় (ফল্ট)। এরপর ১৩৯ বছর পার হলেও এত বড় ভূমিকম্প ওই ফাটল রেখায় আর হয়নি। মধুপুরের ওই ফাটল রেখায় যদি রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়, তাহলে ঢাকায় কমপক্ষে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন ধসে পড়বে, যা ঢাকার মোট ভবনের ৪০ শতাংশ। ওই মাত্রার ভূমিকম্প দিনে হলে কমপক্ষে ২ লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে। আর রাতে হলে কমপক্ষে ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যাবে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সমন্বিত জাতীয় নীতি নেই। যদিও একটি ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ শহর নির্মাণে এ ধরনের একটি সমন্বিত জাতীয় নীতি প্রণয়ন আবশ্যক। ভূমিকম্প সহনীয় স্থাপনা নির্মাণ এবং ভূমিকম্প সহনশীল নগরায়ণে সরকার কাজ করছে।

কালের আলো/এসএকে