মা-ছেলের আবেগঘন মহামিলনের স্বাক্ষী হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
প্রকাশিতঃ 4:53 pm | January 08, 2025
মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:
সাড়ে সাত বছরের বেশি সময়ের অপেক্ষা। দীর্ঘ এই সময়টিতে নানা ষড়যন্ত্র ও পতিত সরকারের নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য মা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যেতে পারেননি বিদেশে। উল্টো কারাগারের অন্ধ নির্জন প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে তাকে। মিথ্যা আর হয়রানিমূলক মামলার জেরে দেশে ফিরতে পারেননি ছেলে, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। ছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে যুক্তরাজ্যে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। রাষ্ট্রপতির এক আদেশে খালেদা জিয়া মুক্তি পান। এরপর দুর্নীতির যে দুটি মামলায় তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন, সেগুলোর রায় বাতিল হয় আদালতে। একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা থেকে খালাস পাচ্ছেন দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি তারেক রহমান।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার (০৭ জানুয়ারি) রাত ১১টা ১০ মিনিটে কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দ শামিলা রহমান সিঁথিকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। মূলত তখন থেকেই মা বেগম জিয়াকে বরণ করে নিতে উন্মুখ ছিলেন তারেক রহমান। অবশেষে সূর্যের ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত সকালে যুক্তরাজ্যের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেগম জিয়া। যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় বুধবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাকে কাছে পেলেন, স্পর্শ নিলেন সন্তান তারেক রহমান। হুইল চেয়ারে বসে থাকা মাকে জড়িয়ে ধরলেন। মাও বুকে টেনে নিলেন আত্মজকে। এ যেন এক মধুর মুহুর্ত। দু’জনেই আবেগাপ্লুত। জিয়া পরিবারের জন্য অবিস্মরণীয়-অভাবনীয় ও অনির্বচনীয় আনন্দের মুহুর্ত।
মা-ছেলের আবেগঘন এক মহামিলনের স্বাক্ষী হয়ে থাকলো যুক্তরাজ্যের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দীর্ঘদিন পর শাশুড়িকে পেয়ে আবেগাপ্লুত পুত্রবধূ চিকিৎসক জুবাইদা রহমানও, যিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জীবন সংগ্রামের জীবন্ত ডায়েরি। তিনিও জড়িয়ে ধরেন শাশুড়িকে। মা-ছেলের পুনর্মিলের মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত অন্যদের নয়নেও যেন বর্ষার বারিধারা। দিনটি অবশ্যই সোনালী দিনের পাতায় জ¦লজ¦ল করে থাকবে অনন্তকাল।
যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রথমেই ফুলের শুভেচ্ছা জানান বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনার হযরত আলী খান। পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান খালেদা জিয়ার পা ছুঁয়ে সালাম করেন। শাশুড়ি-পুত্রবধূর মাঝে ক্ষণিক সময় ভাব বিনিময়। তারপর তারেক রহমান মায়ের হুইল চেয়ারের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে তাকে জড়িয়ে ধরেন। তখন সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে মা-ছেলের পুনর্মিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ উপভোগ করেন ডা. জোবাইদা রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দ শামিলা রহমান সিঁথি, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক ও সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমদসহ দলটির নেতাকর্মীরা। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ভিআইপি প্রটোকল দিয়েছেন খালেদা জিয়াকে।
২০০৭-০৮ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খড়গ নেমে আসে জিয়া পরিবারে। খালেদা জিয়ার মত তার বড় ছেলে তারেক রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে কারাগারে নির্যাতন করে পাজরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান, দেশে আর ফিরতে পারেননি। এর মধ্যে পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারেক রহমানকে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু আর মায়ের কারাগারে যাওয়ার মত দু:সময়েও তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। তার মতো ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার আর কজন রাজনীতিক আছেন! যিনি কিনা স্নেহের আপন ছোটভাইয়ের লাশটি দেখার সুযোগ পাননি-তার কবরটি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
খালেদা জিয়া লন্ডনে গেলে কেবল তখনই মায়ের স্পর্শ পাওয়ার সুযোগ হতো তারেক রহমানের। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে শেষবারের মতো পেয়েছিলেন এই সুযোগ। সেবার নিজে গাড়ি চালিয়ে মাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাড়ে ৭ বছর পর হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে মাকে নিয়ে লন্ডন ক্লিনিকে নিয়ে যান তারেক রহমান। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন থেকে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। এদিন কালো রঙের জ্বিপ গাড়িতে সামনের সিটে ছিলেন জোবাইদা রহমান। আর পেছনের সিটে ছিলেন খালেদা জিয়া ও সিঁথি। পরে সেখানে ভর্তি করেন মা খালেদা জিয়াকে।
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আপোসহীন সংগ্রামী বেগম খালেদা জিয়ার মতো জুলুমের শিকার নারী রাজনীতিক বিশ্বে দ্বিতীয়জনও নেই। যিনি অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। গৃহবধূ থেকে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম করে আপোষহীন নেত্রীর উপাধি পেয়েছেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার বারবার দেশত্যাগের চাপ দিলেও জনগণের কথা ভেবে দলের নেতাকর্মীদের কথা ভেবে যাননি। অথচ জীবন সায়াহ্নে চিকিৎসার বিদেশে যাওয়ার জন্য বারবার আবেদন করেও সেই অধিকারটুকু দীর্ঘকাল পাননি। গণতন্ত্রের জন্য বিএনপি নেত্রীর দীর্ঘ সংগ্রাম পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি মামলায় সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেককে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ কারাভোগের পর ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয়। কিন্তু দুই শর্তের কারণে তিনি কার্যত বন্দি ছিলেন বাসা আর হাসপাতালের জীবনে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য বারবার অনুমতি চাইলেও তাতে সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার।
এবার খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যাত্রা রাজনৈতিক অঙ্গনে ভিন্ন আবহ তৈরি করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় খালেদা জিয়ার প্রয়োজনীয়তা যে কতটুকু তা বলে বোঝানো যাবে না। রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ সবাই উপলব্ধি করেছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি, অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এই বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। গত বছরের ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে তাদের আমন্ত্রণে দীর্ঘ সময় পর স্বশরীরে অনুষ্ঠানে যোগ দেন বেগম জিয়া। এরপর ক’দিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাঁর বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নেন।
কালের আলো/এমএএএমকে