বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পদক্ষেপে জোর সরকারের, জনদুর্ভোগ লাঘবে অ্যাকশনে টাস্কফোর্স

প্রকাশিতঃ 10:56 pm | January 10, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

বায়ুদূষণে ধুঁকছে রাজধানী ঢাকা। দিনের পর দিন অস্বাস্থ্যকর থাকছে রাজধানীর বাতাস। মাঝেমধ্যেই সারা বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকা। বিশ্বের ১২৫ নগরীর মধ্যে বুধবার (০৮ জানুয়ারি) সকালে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ঢাকা। ওইদিন সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার মানসূচকে ঢাকার বায়ুর মান ২০৪। আর শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) বিশ্বের ১২২ নগরীর মধ্যে বায়ুদূষণে চতুর্থ স্থানে ছিল ঢাকা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আইকিউ এয়ারের মানসূচকে ঢাকার বায়ুর মান ২১৯। বায়ুর এই মানকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বায়ুদূষণে অ্যাজমা, নিউমোনিয়ার মতো রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ফলত রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে বা প্রতিকারে অবশ্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। তাঁরা বাইরে বের হলে সুস্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই মাস্ক পরতে পরামর্শ দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বায়ুদূষণের চূড়ায় থাকার দীর্ঘদিনের দুর্নাম ঘুচিয়ে রাজধানীকে নির্মল করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে একগুচ্ছ সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়েছেন। এই পটভূমিতে ঢাকার দূষণ কমানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে তিনি এক সুতোয় গেঁথেছেন, গঠন করেছেন টাস্কফোর্স। সম্প্রতি বিদ্যুৎ ভবনে ‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক সভা থেকে সমন্বিত পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ঘোষণা মোতাবেক ২০ বছরের পুরোনো বাস তুলে নেওয়া, রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিবন্ধনের আওতায় আনতে আইন প্রণয়ন, মহাখালী থেকে বাসস্ট্যান্ড তুলে দেওয়া, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, আশুলিয়াকে ‘নো ব্রিকফিল্ড’ করার চিন্তা, সড়ক বিভাজক ও অনাবৃত জায়গায় ঘাস লাগানোসহ নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছেন।

জানা যায়, ধুলাবালি, যানবাহন আর কলকারখানার ধোঁয়ায় বছরের বড় অংশ জুড়ে ঢাকার বায়ুমান থাকে তলানিতে। সারা বছর চলা নির্মাণকাজ, সড়কের খোঁড়াখুঁড়ি আর আবর্জনা পোড়ানোয় দূষিত হয় বাতাস। ঢাকার পাশের জেলাগুলোর চিত্রও প্রায় এক ও অভিন্ন। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠা এলাকাগুলোতে বায়ুর মান বেশি খারাপ। গাজীপুর, নারায়াণগঞ্জের মতো এলাকাগুলোতেও বায়ু মান থাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায়।

সম্প্রতি বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক এক গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে একদল গবেষক। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় বাইরের বাতাসের চেয়েও বিপজ্জনক ঘরের ভেতরের বাতাস। ঘরের বাতাসে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। গবেষণায় ঢাকায় ৪৩টি ঘরের ভেতরে দূষণের মাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে। বায়ুর মান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। ঘরের গড় দূষণ মাত্রা ছিল ৭৫.৬৯ মাইক্রোগ্রাম/মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা থেকে প্রায় পাঁচগুণ বেশি।

  • বায়ুদূষণ রোধে বা প্রতিকারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের
  • বায়ুদূষণের প্রধান উৎস চিহ্নিত করে নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থা
  • দীর্ঘ সময়ের জঞ্জাল সাফে মনোযোগ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের
  • কিছু এলাকা ‘নো ব্রিকফিল্ড জোন’ ঘোষণা করার উদ্যোগ
  • নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখা ও সুরক্ষা বেষ্টনী ব্যবহারে করতে কঠোর বার্তা
  • সারা দেশে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে বিশেষ অভিযান

সাধারণত বায়ুমান সূচক বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ৫০-এর মধ্যে থাকলে সেই বাতাসকে বলা হয় ভালো। ১০০ পর্যন্ত সহনীয়। ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে হলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ উল্লেখ করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোর ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। আর ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা বিপজ্জনক বলে বিবেচিত।

বাংলাদেশের একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্র (ক্যাপস) বলছে, ২০২২ সালের কোনো মাসেই বায়ুর মান ১০১ একিউআইয়ের নিচে ছিল না; গড় বায়ুমান ছিল ১৫৪.৯৭ একিউআই, অর্থাৎ ‘অস্বাস্থ্যকর’। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রত্যেক মাসে বায়ুর গড় স্কোর ছিল ১৯৪.৮৩ থেকে ২২১ একিউআইয়ের মধ্যে, অর্থাৎ মানুষের সহনশীল মাত্রার চেয়ে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। ২০২২ সালে বর্ষাকালে বায়ুর মান ছিল ১০৫ একিউআইয়ের ওপরে, অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর ছিল। অন্যদিকে ২০২২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বায়ুর মান ছিল যথাক্রমে ১৭৬.২৩ ও ২৪৪.৪৪ একিউআই এবং চলতি জানুয়ারি মাসে দুই দিন ছিল ৩১৭.৪৪ ও ৩০২.৫৪ একিউআই এবং এক দিন ৪০৪.৪৪ একিউআই হয়, যা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। আর এ মাসের ১৭ দিনের বায়ুর মান ছিল ২০০ ওপরে।

সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, কমলাপুর, শাহজাহানপুর ও খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় নির্মাণ সামগ্রীর ধুলাবালিতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এছাড়া রাতে বালুবহনকারী ট্রাকগুলোও ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। যাত্রাবাড়ী এবং জুরাইন এলাকা হয়ে ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিদিন শতশত ট্রাক বালু নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আসে। এসব ট্রাক থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে বালু, উড়ে বেড়ায় বাতাসে। এছাড়া অপরিকল্পিত এই নগরায়নের এই শহরে বিল্ডিং তৈরির কাজ, ইটের ভাটা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বিভিন্ন নির্মাণ কাজে নিয়ম না মানা, যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো, পর্যাপ্ত তদারকির অভাব ইত্যাদি ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।

বায়ুদূষণ রোধে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় আদালত ও মাঠে সমানতালে লড়াই চালিয়েছেন দেশের স্বনামে খ্যাত পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই তিনি মনোনিবেশ করেছেন দীর্ঘ সময়ের জঞ্জাল সাফে। তিনি বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও পানি দূষণ প্রতিরোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সরকার, গণমাধ্যম এবং জনগণকে একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিছু এলাকা ‘নো ব্রিকফিল্ড জোন’ ঘোষণা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে এই উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বায়ুদূষণ নিয়ে আমি ২০১৫ সাল থেকে আদালতে লড়াই করেছি। এখন সরকারে এসে কাজ শুরু করার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৫ সালে আদালত বলেছিলেন একটি এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান দিতে।

  • এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান চূড়ান্ত হয়েছে। সমন্বয়হীনতা যেন না থাকে, সে জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এই টাস্কফোর্স জনদুর্ভোগ কমাতে কাজ করবে।
    সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
    উপদেষ্টা
    পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়

এত বছর কিছু হয়নি। এখন এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান চূড়ান্ত হয়েছে। সমন্বয়হীনতা যেন না থাকে, সে জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এই টাস্কফোর্স জনদুর্ভোগ কমাতে কাজ করবে।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘বায়ুদূষণ কমানো এক-দুই মাস, এক বছরের ব্যাপার নয়। চীনের মতো দেশেরও ১০ বছর লেগেছে দূষণ কমাতে। ধুলো, গাড়ির কালো ধোঁয়া, ইটভাটা, স্টিল মিল থেকে যে দূষণ হচ্ছে, তা কমিয়ে জনদুর্ভোগ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করতে পারি।’

পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বায়ুদূষণের প্রধান উৎস চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নির্মাণ কাজের ধুলা, ইটভাটা এবং যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা। তিনি জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আইন বাস্তবায়ন ও মনিটরিং জোরদার করার মাধ্যমে বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধান করতে চান। বায়ুদূষণ রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয় বলেই তিনি জনগণকে মাস্ক ব্যবহারে উৎসাহিত করছেন একদিন-প্রতিদিন। পাশাপাশি আগামী ছয় মাসের মধ্যে পুরনো গাড়ি অপসারণ করা হবে এবং রাজধানীতে খোলা ট্রাক প্রবেশে পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্মাণ কাজে ধুলা কমাতে পানি ছিটানো, নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখা এবং সুরক্ষা বেষ্টনী ব্যবহারে করতে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। নিয়মিত ভ্যাকুয়াম ট্রাকের মাধ্যমে রাস্তা পরিষ্কার এবং দ্রুত সড়ক মেরামতের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে সড়কের পাশে ঘাস লাগানো, নির্ধারিত স্থানে বর্জ্য ফেলা এবং বর্জ্য পোড়ানো বন্ধের ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন উপদেষ্টা। এছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সারা দেশে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গত রোববার (৬ জানুয়ারি) সারাদেশে ১৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধে মোট ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২শ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এই অভিযানে অবৈধ ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, অবৈধ পলিথিন এবং খোলা জায়গায় নির্মাণ সামগ্রী রাখার কারণে বায়ুদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

দিন কয়েক আগে ‘অ্যানালাইসিস অব এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইন চায়না অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে চীনের সহযোগিতা চেয়েছেন। বেইজিংয়ের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে তিনি চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। চীনের এ-সংক্রান্ত নীতিমালা ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশ অনেক কিছু শিখতে পারে বলে মন্তব্য করেন পরিবেশ উপদেষ্টা।

কালের আলো/এমএএএমকে