শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী ও নিরাপত্তা সদস্যের সংঘাতের ঘটনার নেপথ্যে

প্রকাশিতঃ 10:32 pm | January 11, 2025

ইয়াছিন আরাফাত, কালের আলো:

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সেবার মান যখন দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুড়াচ্ছে ঠিক সেই সময়েই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর খোলনলচে পাল্টে বদলে যাওয়া দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরটিতে গত বুধবার (০৮ জানুয়ারি) নরওয়ে প্রবাসী সাঈদ উদ্দিনের সঙ্গে নিরাপত্তা সদস্যের সংঘাতের ঘটনায় তোলপাড় তৈরি হয়েছে। মূলত বিমানবন্দরটিতে দায়িত্বরত এক নিরাপত্তা সদস্যকে আগমনী ক্যানোপি ২ এর সামনে শারীরিকভাবে সাঈদ ও তাঁর পরিবারের অপর এক সদস্যের আঘাতের ঘটনা থেকেই সংঘাত বেঁধে যায়। বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই দেখছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

ইতোমধ্যেই ঘটনার তদন্তে মন্ত্রণালয় থেকে একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা শনিবার (১১ জানুয়ারি) তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। তাঁরা ফেনীর সোনাগাজি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাঈদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। তদন্ত কমিটি আগামী তিন কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

এদিকে, শনিবার (১১ জানুয়ারি) দুপুরে বিমানবন্দর পরিদর্শন করেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে বিমানবন্দরটি থেকে ব্যাংককগামী হঠাৎ অসুস্থ একজন যাত্রীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদান করে মানবিক এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর নির্দেশে এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক) এর সহযোগিতায় যাত্রীর নির্ধারিত ফ্লাইটে বোর্ডিং সম্পন্ন করা হয়। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা, সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ওই যাত্রী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।

বেবিচক চেয়ারম্যান পরিদর্শনকালে বিমানবন্দরে বিদ্যমান যাত্রীসেবা আরও বেগবান করতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বিমানবন্দর সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতে নিজেদের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বিমানবন্দরের নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলার জন্য যাত্রী স্বজনদেরও আহ্বান জানিয়েছেন।

শাহজালালে কী ঘটেছিল সেদিন?
গত বুধবার (০৮ জানুয়ারি) বিমানবন্দরে যাত্রী ও নিরাপত্তা সদস্যের সংঘাতের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ওইদিন রাত সোয়া ৮টা ২৩ মিনিটের দিকে এই সংঘাতের ঘটনা ঘটে।প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, বিমান বাহিনীর এক নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে নরওয়ে প্রবাসী গিয়াস উদ্দিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরই জেরে প্রথমে তাঁরাই ওই নিরাপত্তা কর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করেন। মূলত ওই পরিবারটির মেজাজ হারানোর ঘটনা থেকেই সেদিন অনাকাঙ্ক্ষিত এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত। ঘটনার রাতে পাঁচ জন আগমনী যাত্রীর একটি দল বিমানবন্দরের কার্যক্রম শেষ করে ক্যানোপি ২ এলাকা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাদের মধ্যে একজন ট্রলিসহ ক্যানোপি ২ এর গেট এর ঠিক সম্মুখভাগে অবস্থান করছিলেন। এটি গেইটটিতে সকল আগমনী যাত্রীর জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ওই সময় আগমনী যাত্রীদের চাপ বেশি থাকায় কর্তব্যরত একজন নিরাপত্তাকর্মী বিনীতভাবে নরওয়ে প্রবাসী সাঈদ উদ্দিনের বাবা গিয়াস উদ্দিনকে কিছুটা সরে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর কথা কানে তুলেননি।

কিছুক্ষণ পর পুনরায় ওই নিরাপত্তা কর্মী তাকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন এবং অকথ্য-অশ্রাব্য ভাষায় নিরাপত্তা কর্মীকে গালিগালাজ করতে থাকেন। এ সময় ওই স্থানে নিয়োজিত আরও একজন নিরাপত্তা কর্মী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলে এক পর্যায়ে একই ফ্লাইটের যাত্রী, তাঁর পুত্র সাঈদ যিনি পেছনে অবস্থান করছিলেন তিনি বিমান বাহিনীর ওই নিরাপত্তা কর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করেন। তাঁরা সেই নিরাপত্তাকর্মীকে কিলঘুষি মারা শুরু করলে তাদের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি হয় এবং ওই নিরাপত্তা কর্মী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেখানে নিয়োজিত আনসার এবং এভিয়েশন সিকিউরিটি এর সদস্যরা এগিয়ে এলে নিরাপত্তা কর্মীদেরকে ওই যাত্রীদের হাত থেকে মুক্ত করা হয়। এই ঘটনায় জড়িত যাত্রীকে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য বিমানবন্দরের বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যাত্রীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা সাপেক্ষে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বলেছেন, ‘সম্প্রতি এক প্রবাসীর সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এখানে কর্তব্যরত সদস্যদের সঙ্গে নরওয়ের ওই পরিবার যে আচরণ করেছেন সেটিও দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরে আসার পর আমাদের কতিপয় প্রবাসী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, তারা হরহামেশাই নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন। আমাদের নিরাপত্তা সদস্যরা সেগুলো অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে মোকাবিলা করেন। মনে রাখতে হবে এখানে নিয়মশৃঙ্খলা রয়েছে। কেউ এই শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রবাসী ভাইয়েরা আমাদের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখেন। তাদের জন্যই আমাদের সব কিছু। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর সেগুলো ভুলে ইচ্ছেমতো আচরণ করলে তো সবাই কষ্ট পাবে। আমাদেরও দুর্নাম হবে। আমরা চাই না বিমানবন্দরের সুনাম নষ্ট হোক।’

বেবিচক ও বিমান বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপের ফলে সেখানে যাত্রীসেবার আমূল পরিবর্তন
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে বছরে প্রায় ৫৫ হাজার ও অভ্যন্তরীণ রুটে প্রায় ৫৩ হাজার ফ্লাইট পরিচালিত হয়। আন্তর্জাতিক রুটে বছরে প্রায় ৯৫ লাখ এবং অভ্যন্তরীণ রুটে প্রায় ২৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন। ২০২৩ সালে প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেছেন। আগে বিমানবন্দরটিতে নানাভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে যাত্রীদের। এখন বেবিচক ও বিমান বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপের ফলে সেখানে যাত্রীসেবার আমূল পরিবর্তন এসেছে। লাগেজ কাটা ও চুরি নিয়ে যাত্রীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ আর শোনা যায় না। প্রায় ৮৮ শতাংশ যাত্রীর কাছে ১৫ মিনিট থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে লাগেজ ডেলিভারি নিশ্চিত হয়েছে। লাগেজ বহনের সুবিধার্থে বিমানবন্দরে নতুন সংযোজনের পর ট্রলির সংখ্যা বেড়ে ৩ হাজার ৬০০টিতে দাঁড়িয়েছে। ক্যানোপি থেকে বের হয়ে বহুতল পার্কিং ও রাস্তার পর্যন্ত প্রত্যেক যাত্রীর জন্য ট্রলিতে করে লাগেজ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মাসখানেক আগে ওই ওয়েটিং লাউঞ্জের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের মাল্টিলেভেল কার পার্কিং এলাকার দ্বিতীয় তলায় এই প্রশস্ত ওয়েটিং লাউঞ্জ নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন এই লাউঞ্জে যাত্রীদের অপেক্ষা করার কক্ষ, বেবি কেয়ার কক্ষ, নারী-পুরুষ উভয়ের আলাদা ইবাদতখানা এবং ক্যাফেটেরিয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রবাসী রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের জন্য প্রবাসী লাউঞ্জ এবং নতুন-পুরোনো সব যাত্রীর সহযোগিতার জন্য আগমন ও বহির্গমন এলাকায় তাদের তথ্য ও দিকনির্দেশনা দিতে নতুন করে হেল্পডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক বহির্গমন এলাকার গেটের সামনে দেখা যায় রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের প্রবাসী লাউঞ্জসহ ভেতরের এসব সুবিধা নিতে সচেতন করছেন নিরাপত্তাকর্মীসহ স্বেচ্ছাসেবকরা।

সর্বোচ্চ সেবা দিতে কাজ করছেন জানিয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের যাত্রীসেবার জন্য আমরা একটি টিম ওয়ার্ক পরিচালনা করছি। সবার প্রতি আহ্বান থাকবে বিমানবন্দরে এসে সেখানকার নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা রাখার। যারা এখানে কাজ করেন তাদেরও সম্মানের সঙ্গে দেখতে হবে। আমাদের লোকজন প্রবাসীসহ সব যাত্রীদের যেহেতু সম্মান করে তাদের কাজের প্রতিও সম্মান দেখানো উচিত। মনে রাখতে হবে এটি আমাদের দেশ। বিমানবন্দরও আমাদের দেশের অংশ। তাই এটির মর্যাদা যেমন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধরে রাখতে হবে তেমনি যাত্রীদেরও সেই বিষয়ের প্রতি নজর রাখতে হবে। সবার সহযোগিতায় আমরা যাত্রীসেবার মান অক্ষুণ্ন রাখতে বদ্ধপরিকর।’

কালের আলো/ওয়াইএ/এমকে