বিমান বাহিনী প্রধানের পরিদর্শনে আশার সঞ্চার, রানওয়ে সুবিস্তৃত করে দেড় বছরের মধ্যেই সচল সম্ভব বগুড়া বিমানবন্দর

প্রকাশিতঃ 9:58 pm | January 12, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

অধীর অপেক্ষা ছিল। একটু দেরিতে হলেও সেই প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে। অবশেষে প্রায় প্রায় দুই যুগ পর সম্ভাবনাময় বগুড়া অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত পতিত সরকারের রাজনৈতিক অনাগ্রহের কারণেই আলোর মুখ দেখেনি লাল ফিতার গিট্টুতে আটকে থাকা এই বিমানবন্দরটি। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের জনপ্রত্যাশা উপেক্ষিত থেকেছে বছরের পর বছর। কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর চারটি ধাপে বিমানবন্দরকে ঘিরে পরিকল্পনা সাজিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শুরু হয়েছে জোর তৎপরতা।

বিমানবন্দরটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে বগুড়ায় ছুটে গেছেন বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। কুয়াশার চাদর সরিয়ে ঝলমলে রুদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়ায় রবিবার (১২ জানুয়ারি) যখন বিমান বাহিনী প্রধান বগুড়ার মাটিতে পা রাখেন ঠিক তখন থেকেই নতুন আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে উত্তরবঙ্গের মানুষ। এদিনের সূর্য যেন বগুড়াবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আলোকিত এক ভবিষ্যতের। বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ এদিন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়াকে সঙ্গে নিয়ে বগুড়ায় অবস্থিত শর্ট ফিল্ড টেক অফ এন্ড ল্যান্ডিং (STOL Port) রানওয়ে পরিদর্শন করেন। তিনি বগুড়া রানওয়েকে ‘স্ট্র্যাটেজিক হাব’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

প্রকৌশলগত কাজ, ৬ হাজার ফুট সুবিস্তৃত রানওয়ে ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে খসড়া পরিকল্পনা অনুমোদন হলেই এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই পুরোদমে বিমানবন্দরটি চালু করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন বিমান বাহিনী প্রধান। তবে এজন্য তিনি বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। নিজের বর্ণাঢ্য চাকরি জীবনে তিনিও নিজেও অনেকবার শুনেছেন এই বিমানবন্দরের দাবির কথা। সেই কথাই স্মরণে এনে নতুন স্বপ্নের আশাবাদে তিনি বলেন, ‘আমি ৪০ বছর যাবত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে চাকরি করছি। আমি জানি আপনাদের এই দাবি দীর্ঘদিনের। এতোদিন আপনারা ধৈর্য্য ধরেছেন। এখন আরেকটু ধৈর্য্য ধরেন। সামনে ভালো সংবাদ আপনারা পাবেন।’

  • বিমান বাহিনী প্রধানের জবানীতে বগুড়ার এয়াফিল্ডের ইতিহাস
  • বগুড়া রানওয়ের বর্তমান অবস্থা খুবই দুর্বল
  • বগুড়া রানওয়ে হচ্ছে ‘স্ট্র্যাটেজিক হাব’

স্থানীয় জনসাধারণের ভাষ্য হচ্ছে- এতোদিন রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, জমি অধিগ্রহণসহ নানা ধরনের জটিলতা দেখিয়ে বগুড়ার অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরটি চালু করা হয়নি। অথচ বগুড়ায় কৃষিপণ্য পরিবহন ও পর্যটক আকর্ষণ করতে বিমানবন্দরটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এজন্য বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে ৬ হাজার ফিট বিস্তৃত রানওয়ে ও বিনিয়োগ। এবার নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সমীক্ষাও শেষ হয়েছে। বগুড়ায় এয়ারফিল্ডকে বিমানবন্দরে উন্নতি করা সম্ভব হলে স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। বিকাশ ঘটবে পর্যটনেরও।

বিমান বাহিনী প্রধানের জবানীতে বগুড়ার এয়াফিল্ডের ইতিহাস
বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন সব সময় কথা বলেন সোজা-সাপ্টা। ইতিহাসের বিস্মৃতির আখ্যান থেকে তিনি বলেন, ‘বগুড়া রানওয়েটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেকবার প্রস্তাব দিয়েছি কিন্তু তখনকার সরকারের এটি প্রায়োরিটিতে ছিল না। এই এয়ারফিল্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে স্বাধীনতার পর যখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ফরমেশন হলো তখন থেকে আমাদের এখানে অবস্থান রয়েছে। পরবর্তীতে আমরা যখন এগুলোকে বিভিন্নভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলাম এবং অভ্যন্তরীণ রুটে যখন আমাদের নিজস্ব দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল ছিল, ঢাকা থেকে বগুড়ায় যেভাবে আসতে হতো তখন এই জায়গাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল যাতে এয়ার কানেকটিভিটি থাকে। পরবর্তীতে এখানে শর্ট ফিল্ড টেক অফ এন্ড ল্যান্ডিং (STOL Port) নির্মাণ করা হয়েছিল, বেশ কিছুদিন আমাদের ক্ষুদ্র বিমান স্বল্প দৈর্ঘ্য রানওয়েতে অপারেট করতে পারতো। পরবর্তীতে যমুনা সেতু নির্মাণের পর এটি বিমান বাহিনী নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহার করে আসছে। সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) রয়েছে। বাংলাদেশে বিমান বাহিনীর যতো ঘাঁটি রয়েছে সেগুলো আমরা যৌথ ব্যবহার করি। যৌথ ব্যবহার করতে কোন সমস্যা নেই। যেহেতু আমাদের দেশ ছোট, রিসোর্সেস কম এভাবে ব্যবহার করাটাই সাশ্রয় হবে। অন্যান্য অনেক এয়ারফিল্ড নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং অব্যবহারযোগ্য হয়ে গেছে। এটির দৈর্ঘ্য ছোট হতে পারে। কিন্তু এটি এখনও আল্লাহর রহমতে সম্পূর্ণ সচল একটি বিমান বন্দর এবং রানওয়ে হিসেবে আছে।’

বগুড়া রানওয়ের বর্তমান অবস্থা খুবই দুর্বল
এই রানওয়ের অবস্থা বর্তমানে খুবই দুর্বল বলে জানান বিমান বাহিনী প্রধান। তিনি বলেন, ‘এই রানওয়ের শক্তিও কমে গেছে। এটির শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে এবং সার্ফেসকে স্ট্রং করতে হবে। যদি এটি আমরা ডমেস্টিক পারপাসে ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারি। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও প্রাইভেট এয়ারলাইন্স ব্যবহার করতে চাইলে রানওয়ে বৃদ্ধি করতে হবে। এখন আমরা এটিকে আবার প্রায়োরিটি দিচ্ছি। বেবিচক চেয়ারম্যান উপস্থাপন করবেন। শুরুতেই আমরা রানওয়ের অপারেশনাল সার্ফেস কার্যক্রম চালুর চেষ্টা করবো। যাতে করে আমাদের ইমিডিয়েট কোন ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং হতে হলে বা কোন কারণে কোন বিমান এখানে ল্যান্ড করাতে হলে এখানে করতে পারবো। সেটা হচ্ছে কম প্যাসেঞ্জার ও কম তেল নিয়ে। ফুল অপারেশন করতে হলে রানওয়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করতে হবে মিনিমাম দেড় থেকে দুই হাজার ফিট। সেজন্য রানওয়ের পূর্ব দিকের রাস্তার দিকে সম্ভব না। শুধুমাত্র পশ্চিম দিকে যেতে পারি। সেখানে একটি গ্রাম রয়েছে। সেখানে খুবই কম মানুষ থাকে। তাদেরকে আমরা পুনর্বাসন করে রানওয়ে এক্সটেনশন করতে হবে। রানওয়ের সঙ্গে এজ, স্ট্রেন্থেনিং ও লাইটিংসহ অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে। সবকিছুর জন্য আমাদের সম্মিলিত একটি বোর্ড করা হবে। বেবিচক এটাকে লিড দিবে। আমরা এই বোর্ডের মাধ্যমে এক্সাট আমাদের রিকুয়ারমেন্ট বের করবো। তাঁরা ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। পরবর্তীতে আমরা এটি আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে উপস্থাপন করবো। আমরা যদি ফান্ডিং পাই তাহলে অবশ্যই কাজ শুরু হবে। আর যদি না হয় তাহলে আমরা অপেক্ষা করবো, ধৈর্য্য ধরবো। পরবর্তীতে যখন নির্বাচিত সরকার আসবে তাদের দিকনির্দেশনা মোতাবেক কাজ করবো।’

বগুড়া রানওয়েকে স্ট্র্যাটেজিক হাব হিসেবে মনে করেন বিমান বাহিনী প্রধান
অনেকে লালমনিরহাট ও সৈয়দপুরকে ‘স্ট্র্যাটেজিক হাব’ হিসেবে মনে করলেও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বগুড়া রানওয়েকে ‘স্ট্র্যাটেজিক হাব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে হয়তো এখানে দুর্যোগ হচ্ছে না। এক সময় এই এলাকা বন্যাকবলিত ছিল। ভবিষ্যতেও যে আবার এমনটি হবে না সেটা আমরা জানি না। সুতরাং এটি রিলিফ অপারেটিং সেন্টার হতে পারে। আমরা ভূমিকম্পের কথা শোনছি। কখন কোথায় দুর্যোগ হয় আমরা সেটি জানি না। এরকম কোন দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হলে আমরা এখান থেকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারবো। আমরা বিমান বাহিনী থেকে মাঝারি থেকে বড় আকারের পরিবহন বিমান এখানে নিয়ে আসতে পারবো। ত্রাণ তৎপরতাসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। এটি হচ্ছে সেন্টার অব দি নর্থ বেঙ্গল।’

‘বগুড়া বিমানবন্দর CASEVAC এবং MEDEVAC মিশনের জন্য অপরিহার্য, যার মাধ্যমে এই এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুমূর্ষু রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত সরিয়ে নেওয়া সম্ভব বলেও জানান বিমান বাহিনী প্রধান। তিনি বলেন, ‘এই রানওয়ের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ জাতীয় নিরাপত্তা এবং জরুরী উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। সময়মতো পুনঃকার্পেটিং করা সম্ভব হলে রানওয়ের ভবিষ্যত অবস্থার অবনতি রোধ করবে যা পরবর্তীতে অতিরিক্ত অর্থ সাশ্রয় হবে। এই রানওয়ে ভিভিআইপি ফ্লাইটগুলোর জন্য একটি বিকল্প এবং জরুরি অবতরণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে যা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে উদ্ভত যেকোন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা পালন করে।’

বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, ‘বর্তমানে বেবিচক চারধাপে একটি পরিকল্পনা করেছেন। বর্তমান যেখানে আছে সেখান থেকে সেকেন্ড ধাপ করলে মোটামুটি ছোট বিমান আসতে পারবে। সেজন্য প্রয়োজন ৬ হাজার ফিট রানওয়ে। কিন্তু এটিকে যদি আমরা বড় বিমান (সেভেন থ্রি সেভেন লেভেল বা এরচেয়েও বড়) আনতে যাই তাহলে ৮ হাজার ফিট ও বড় বিমান আনতে গেলে ১০ হাজার ফিট রানওয়ে লাগবে। ৬ হাজার ফিট রানওয়ে করতে হলে ফান্ডিং ও সরকারের অনুমোদন পেলে ইনশাআল্লাহ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। রানওয়ে সম্প্রসারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রানওয়ের উপরিভাগকে সরিয়ে আবার নতুন করে করতে হবে। এটি একটি ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্ক। সর্বোচ্চ মনোযোগ দিলেও এক বছর প্লাস সময় লাগবে। এটি আমাদের পরিকল্পনা। আমরা এটিকে সরকারের সামনে উপস্থাপন করবো।’

কালের আলো/এমএএএমকে