উত্তপ্ত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড

প্রকাশিতঃ 9:23 am | January 13, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

গত ১০ জানুয়ারি (শুক্রবার) রাত। রাজধানীর ব্যস্ত এলিফ্যান্ট রোডে প্রকাশ্যেই ২০ থেকে ২৫ জন দুর্বৃত্তের এক থেকে দেড় মিনিটের অতর্কিত হামলার শিকার হন এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্য সচিব এহতেশামুল হক। এ ঘটনার একটি ১০-১২ সেকেন্ডের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাতে চাপাতি দিয়ে কোপানোর নৃশংসতা দেখা গেছে। এতেই শুরু হয় তোলপাড়।

হাত ও পায়ে মারাত্মক জখম নিয়ে এহতেশাম এখনো হাসপাতালে ভর্তি। আর হাতে জখম নিয়ে চিকিৎসা শেষে ছাড়া পেয়ে ১১ জানুয়ারি রাতে নিউ মার্কেট থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন ব্যবসায়ী দীপু। ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী দীপু মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের বড় ভাই। দায়ের করা মামলায় দীপু চাঁদাবাজির জেরে হামলায় জড়িত হিসেবে ১০ জনের নাম উল্লেখসহ ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা পরিচয়ের আসামি করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল হক ওরফে ইমন (৫২)কে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মুন্না (৪৭), আসিফ ঝন্টু (২৮), একেএম চঞ্চল (৪৩), শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সহযোগী খোকন (৪০), সাইদ আসাদ (৪১), জসিম ও কলা জসিম (৩৫), তুষার ওরফে কিলার তুষার (৩৫), তৌফিক এহসান (৬৩) ও মো. জাহিদ (৪৪)। এ ঘটনায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

প্রকাশ্যে দু’ব্যবসায়ীকে কুপানোর ঘটনায় নতুন করে সামনে এসেছে রাজধানীর অপরাধ জগতের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন ও মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের নাম। একসময় তাঁরা দু’জনই অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ করতেন। গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর গত ১৫ ও ১৬ আগস্ট কারাগার থেকে এরা জামিনে বের হয়েছেন। দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বের জেরেই ঘটেছে এই ঘটনা। এর মাধ্যমে রীতিমতো উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। যেকোন সময় আরও বড় রকমের ঘটনা ঘটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার শঙ্কাও তাড়া করে ফিরছে। এই লক্ষ্যেই পরিকল্পনামাফিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাজধানীতে আতঙ্ক তৈরি করার অপতৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। শক্ত হাতে চিহ্নিত এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীকে দমনের জোর দাবি ওঠেছে।

দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব খতিয়ে দেখছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, মোহাম্মদপুরের খুনের ঘটনায় পিচ্চি হেলাল গ্রেপ্তার না হলেও দুই-তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপরও পুলিশের নজরদারি রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী হোক বা যেই হোক, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।’ তিনি বলেন, এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখমের নেপথ্যে মার্কেটের কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব ও চাঁদাবাজির অভিযোগ জেনেছি। মামলায় আসামি করা হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে। বাদী আবার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের বড় ভাই।

নিউ মার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় এজাহারে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লব পরবর্তীসময়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে দলবদ্ধ হয়ে মার্কেটের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনসহ অন্য আসামিরা মার্কেটের ব্যবসায়ীদের নানাভাবে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিয়ে হয়রানি করে আসছিলেন। আসামিদের চাঁদাবাজি ও হয়রানির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী বাদী ও অপর ভুক্তভোগী এহতেশামুল হকসহ আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী আইনি সহযোগিতা গ্রহণসহ ব্যবসায়ী ও ছাত্রজনতাকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এতে অভিযুক্ত আসামিদের চাঁদাবাজি ব্যাহত হয়। মূলত এ কারণেই ভুক্তভোগী এহতেশামুল হকসহ রোষানলে পড়তে হয়। পূর্বপরিকল্পিতভাবে আসামিরা ১০ জানুয়ারি রাত পৌনে ১১টার দিকে নিউমার্কেট থানাধীন নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ইসিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার) পশ্চিম দিকে রাস্তার ওপর ধারালো ছোরা, চাপাতিসহ দলবদ্ধ হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি কোপায়।

এহতেশামুল গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে গাড়িতে করে বের হয়ে আসতে থাকলে আসামিদের কয়জন গ্রাউন্ড ফ্লোরের গেটের ভেতরে ঢুকে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। কোপের আঘাতে তার গাড়ির কাচসহ বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগৃস্ত হয়। আসামিদের এলোপাতাড়ি চাপাতির কোপে তার সোলজার জয়েন্ট, ডান হাতের কনুই, ডান পায়ের হাঁটু, বাম পায়ের পাতাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়। পরে স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ সাধারণ জনতা এগিয়ে এলে আসামিরা ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে পালিয়ে যায়।

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৬ আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পান। তাদের বেশিরভাগই এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত ১৫ আগস্ট দুপুরে মুক্তি পান আওয়ামী লীগ সরকারের পুরস্কার ঘোষিত ২৩ সন্ত্রাসীর অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। আর ১৬ আগস্ট রাতে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার-৪ থেকে জামিনে মুক্তি পান অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল। কারামুক্তির পর এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০০ সালের ১২ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন তৎকালীন ছাত্রদলের নেতা পিচ্চি হেলাল। দীর্ঘ ২৪ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পাওয়া শীর্ষ এ সন্ত্রাসীর বড় ভাই ওয়াহিদুল হাসান দীপু। যিনি গত ১০ জানুয়ারি আকস্মিক হামলার শিকার দুই ভুক্তভোগীর একজন। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইমামুল হাসান হেলাল ছিলেন মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক, মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক। বিএনপি ঘোষিত সব কর্মসূচি হেলালের নেতৃত্বে মোহাম্মদপুর এলাকায় সম্পন্ন হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গ্রেপ্তারের পর পুলিশের প্রকাশিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় ওঠে পিচ্চি হেলালের নাম।

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের আলো’কে বলেন, কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে পিচ্চি হেলাল ও ইমন অন্যতম। তাদের সংস্পর্শে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে এসেছেন। তারা অপরাধের পুরোনো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দেওয়ার পাশাপাশি চাঁদা চেয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের তৎপরতা দৃশ্যমান। গত ২০ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে সাদেক খান আড়তের সামনে জোড়া খুন হয়। ওই দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকার ‘দখল’ নিতে সন্ত্রাসীদের দুই পক্ষের বিরোধ থেকে জোড়া খুনের ওই ঘটনা ঘটে। তবে ওই ঘটনার পর চার মাসেও পিচ্চি হেলালকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

কালের আলো/আরআই/এমএসএ