বিভ্রান্তির অপকৌশলে কী ধামাচাপা পড়ছে শাহজালালে নিরাপত্তা সদস্যকে সেই প্রবাসীর ‘আঘাত’?

প্রকাশিতঃ 12:34 pm | January 14, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

নরওয়ে প্রবাসী এক যাত্রী ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা কাটাকাটির ঠুনকো ঘটনা থেকে তৈরি হওয়া সংঘাতে হঠাৎ আলোচনায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। গত কয়েকদিন ধরেই গণমাধ্যমে আলোড়ন। কোন কোন গণমাধ্যম সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ না করেই নিরাপত্তা সদস্যকে তোপ দাগছেন। কেউ কেউ আবার আরও এক কাঠি সরেস হয়েই নিরাপত্তা কর্মীটিকেই দোষী সাব্যস্ত করতেও ছাড়ছেন না। অপসাংবাদিকতার চোরাবালিতে সেঁধিয়ে গিয়েছেন এমনও রয়েছে। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। যারা কথা বলেছেন নরওয়ে প্রবাসী সেই সাঈদ উদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় মেজাজ হারিয়ে ওই প্রবাসী প্রথমে কেন এবং কী কারণে নিরাপত্তা সদস্যকে আঘাত করে নিজের বীরত্ব জাহির করতে চাইলেন এমন প্রশ্ন গণমাধ্যমে ওঠে না এলেও অনলাইনে-অফলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে ঢের। ইউনিফর্ম পরিহিত একটি বাহিনীর সদস্যকে লাঞ্ছিত করার মতো অগ্রণযোগ্য একটি কর্ম সম্পন্ন করলেও মুখে কুলুপ এঁটেছেন অনেকেই। উল্টো জনমনে ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তি। এই দায় কে নিবেন, এমন প্রশ্নও শোনা যাচ্ছে কান পাতলেই।

এর আগে গত বুধবার (০৮ জানুয়ারি) রাত ৮টা ২৩ মিনিটের দিকে বিমানবন্দরটিতে অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনাটি ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও প্রাথমিক তদন্ত থেকে জানা গেছে, বিমানবন্দরটিতে দায়িত্বরত এক নিরাপত্তা সদস্যকে আগমনী ক্যানোপি ২ এর সামনে শারীরিকভাবে সাঈদ ও তাঁর পরিবারের অপর এক সদস্যের আঘাতের ঘটনা থেকেই সংঘাত বেঁধে যায়। কিন্তু পুরো সিসিটিভি ফুটেজে চোখ না দিয়ে ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদে সম্পৃক্ত একটি চক্রকে পুনর্বাসিত করতেই গত ৫ মাসে যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অর্জিত সুনামকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। ফলে প্রকৃত ঘটনা তাদের কাছে উপেক্ষিত থেকেছে।

একটি মিথ্যাকে বারবার বললে না কী সেটি সত্যের মতো শোন যায়। স্বার্থের জন্য ন্যূনতম নীতি-নৈতিকতা বা মানবিকতাবোধটুকুও হারিয়ে যেতে বসায় নানা বয়ান আর গল্প এখানে উপজীব্য হয়ে ওঠেছে। স্মৃতিবিভ্রম হয়েছে বলেই কীনা অনেকেই ভুলতে বসেছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পূর্বেও কী এক ভোগান্তি নিত্যসঙ্গী ছিল শাহজালালে। দিনের পর দিন জেঁকে বসা পর্বতসমান সেইসব অনিয়ম, দুর্নীতি আর ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে যখন পরিবর্তনের হাওয়া বইছে বিমানবন্দরটিতে তখনই ধান্ধা হারানো চক্রটি নানাবিধ অপকৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ওই যাত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) অভিযোগ করবেন বলে জানালেও নরওয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোন দেশ নয়। আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি কাড়তেই তাঁরা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে বলেও মনে করছে কোন কোন সূত্র।

দেশের প্রধান এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম ও সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে এই দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ফুটে ওঠেছে। বিমানবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম দেশের ভাবমূর্তিকে করেছে উজ্জ্বল। বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপে যাত্রীসেবাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিনই হাজার হাজার প্রবাসী বিমানবন্দরে প্রাপ্ত সেবার মান দিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রেমিটেন্স যোদ্ধাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধনের নতুন একটি প্রথাও চালু হয়েছে। ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে অক্ষত লাগেজ ডেলিভারি, হেল্পডেস্ক, ফ্রি কল করা, ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সুবিধা, লাগেজ বহনের সুবিধার্থে ট্রলি, ক্যানোপি থেকে বের হয়ে বহুতল পার্কিং ও রাস্তার পর্যন্ত প্রত্যেক যাত্রীর জন্য ট্রলিতে করে লাগেজ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাসহ ইত্যাকার সুবিধা হয়েছে নিশ্চিত।

মাসখানেক আগে ওই ওয়েটিং লাউঞ্জের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের মাল্টিলেভেল কার পার্কিং এলাকার দ্বিতীয় তলায় এই প্রশস্ত ওয়েটিং লাউঞ্জ নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন এই লাউঞ্জে যাত্রীদের অপেক্ষা করার কক্ষ, বেবি কেয়ার কক্ষ, নারী-পুরুষ উভয়ের আলাদা ইবাদতখানা এবং ক্যাফেটেরিয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রবাসী রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের জন্য প্রবাসী লাউঞ্জ এবং নতুন-পুরোনো সব যাত্রীর সহযোগিতার জন্য আগমন ও বহির্গমন এলাকায় তাদের তথ্য ও দিকনির্দেশনা দিতে নতুন করে হেল্পডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক বহির্গমন এলাকার গেটের সামনে দেখা যায় রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের প্রবাসী লাউঞ্জসহ ভেতরের এসব সুবিধা নিতে সচেতন করছেন নিরাপত্তাকর্মীসহ স্বেচ্ছাসেবকরা।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এর মধ্যে দিয়ে ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর বদলে যেতে শুরু করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দৃশ্যপট। এই সময়ে কোন প্রবাসী যাত্রীর মুখে সেবার মান বা নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যবহার নিয়ে টু শব্দটি উচ্চারিত না হলেও গত বুধবার (০৮ জানুয়ারি) নরওয়ে প্রবাসী যাত্রী সাঈদ উদ্দিন ও তাঁর পরিবারের নিয়ম শৃঙ্খলা মানতে থোড়াই কেয়ার মনোভাব শাহজালালকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁই দিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত। ঘটনার রাতে পাঁচ জন আগমনী যাত্রীর একটি দল বিমানবন্দরের কার্যক্রম শেষ করে ক্যানোপি ২ এলাকা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাদের মধ্যে একজন ট্রলিসহ ক্যানোপি ২ এর গেট এর ঠিক সম্মুখভাগে অবস্থান করছিলেন। এটি গেইটটিতে সকল আগমনী যাত্রীর জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

ওই সময় আগমনী যাত্রীদের চাপ বেশি থাকায় কর্তব্যরত একজন নিরাপত্তাকর্মী বিনীতভাবে নরওয়ে প্রবাসী সাঈদ উদ্দিনের বাবা গিয়াস উদ্দিনকে কিছুটা সরে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর কথা কানে তুলেননি। কিছুক্ষণ পর পুনরায় ওই নিরাপত্তা কর্মী তাকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন এবং অকথ্য-অশ্রাব্য ভাষায় নিরাপত্তা কর্মীকে গালিগালাজ করতে থাকেন। এ সময় ওই স্থানে নিয়োজিত আরও একজন নিরাপত্তা কর্মী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলে এক পর্যায়ে একই ফ্লাইটের যাত্রী, তাঁর পুত্র সাঈদ যিনি পেছনে অবস্থান করছিলেন তিনি বিমান বাহিনীর ওই নিরাপত্তা কর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করেন। তাঁরা সেই নিরাপত্তাকর্মীকে কিলঘুষি মারা শুরু করলে তাদের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি হয় এবং ওই নিরাপত্তা কর্মী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেখানে নিয়োজিত আনসার এবং এভিয়েশন সিকিউরিটি এর সদস্যরা এগিয়ে এলে নিরাপত্তা কর্মীদেরকে ওই যাত্রীদের হাত থেকে মুক্ত করা হয়। এই ঘটনায় জড়িত যাত্রীকে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য বিমানবন্দরের বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যাত্রীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা সাপেক্ষে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

দেশের বেসরকারি অনেক টেলিভিশন চ্যানেলের ইউটিউবে আপলোড হয়েছে সেদিনের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ। এর মধ্যে একটি চ্যানেলে সানজিদা শ্রাবণী নামে একজন মন্তব্য লিখেছেন-‘প্রবাসী লোকটাই অন্যায় করেছে, এই ভিডিও দেখে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে।’ সিরাজুল হক নামে একজন লিখেছেন- ওই প্রবাসী যে অন্যায় করেছে সেটি নরওয়ে গভর্নমেন্টকে জানানো উচিত। নরওয়ে সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে দিবে।’ আব্দুল হক লিখেছেন-‘ঘটনা দেখে ষ্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, প্রবাসী ব্যক্তিটির আক্রমণাত্মক কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।’ ইনোস্টে বয় নামের আইডি থেকে লেখা হয়েছে-‘হুজুগে বাঙালিদের স্বভাব দেখলে আমার অবাক লাগে। যখন এই এই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে প্রবাসী ব্যক্তিটি দোষী তখন এই ভিডিওতে কমেন্ট করলো মাত্র ৭০ জন। আর যদি নিরাপত্তা কর্মী তথা সরকারের বিপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যেত তাহলে হাজার হাজার মানুষ কমেন্ট করতো। এজন্যই গণমাধ্যম কর্মীরা যে খবরে বেশি কমেন্ট, লাইক পড়ে সেই সংবাদটাই প্রচার করে হোক সেটা মিথ্যা বা ভুল।’ একজন লিখেছেন-‘বিদেশে নিয়ম মানে আর দেশে আসলে নিয়ম মানে না। বড়লোকি ফাজলামো করে। মাঝখানে বাংলাদেশে সরকারের বদনাম হয়।’

এসব বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বলেছেন, ‘সম্প্রতি এক প্রবাসীর সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এখানে কর্তব্যরত সদস্যদের সঙ্গে নরওয়ের ওই পরিবার যে আচরণ করেছেন সেটিও দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরে আসার পর আমাদের কতিপয় প্রবাসী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, তারা হরহামেশাই নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন। আমাদের নিরাপত্তা সদস্যরা সেগুলো অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে মোকাবিলা করেন। মনে রাখতে হবে এখানে নিয়মশৃঙ্খলা রয়েছে। কেউ এই শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রবাসী ভাইয়েরা আমাদের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখেন। তাদের জন্যই আমাদের সব কিছু। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর সেগুলো ভুলে ইচ্ছেমতো আচরণ করলে তো সবাই কষ্ট পাবে। আমাদেরও দুর্নাম হবে। আমরা চাই না বিমানবন্দরের সুনাম নষ্ট হোক।’

কালের আলো/আরআই/এমএসএএকে