ওষুধের দামে লাফ

প্রকাশিতঃ 8:55 am | January 15, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

হঠাৎ করেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বাড়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের জেরে যখন নাভিশ্বাস ওঠেছে জীবনে ঠিক সেই সময়ে ওষুধের দাম বাড়ার আশঙ্কায় জিম্মি হচ্ছেন রোগীরা। বিশেষ করে যাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের অবস্থা হবে বেশি শোচনীয়। গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, তার মধ্যে ওষুধও রয়েছে। অধ্যাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে ওষুধের ওপর ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাট বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, যা ৯ জানুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়েছে।

মূল্য স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাটসহ প্রতি একক ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত মূল্যের মধ্যে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ও আইনের তৃতীয় তফসিলের অনুচ্ছেদ (৩) অনুযায়ী ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২.৪ শতাংশ ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই ভ্যাট বেড়ে এখন ৩ শতাংশ করা হয়েছে। তাই ওষুধের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর তাতে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে জনমনে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের চিকিৎসাবাবদ মোট খরচের বড় অংশ ব্যয় হয় ওষুধ কিনতে। এতে ওষুধভেদে বড় ব্যবধানে দর বাড়লে বিপাকে পড়বে সাধারণ মানুষ। এর সার্বিক প্রভাব জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়বে। আর ওষুধের মূল্য নিয়ে বাজারে অব্যাহতভাবে চরম নৈরাজ্য শুরু হবে। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলোর অধিক মুনাফা অর্জন ও দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধের দিকে নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। তা না হলে দেশের চিকিৎসা খাত নিম্নবিত্ত মানুষের আওতার বাইরে চলে যাবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার পরামর্শ তাদের।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সর্বশেষ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ চলে যায় ওষুধের পেছনে। মানুষ নিজের পকেটের ১০ দশমিক ১ শতাংশ খরচ করে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, রোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, ওষুধে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং চিকিৎসা সামগ্রীতে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য অন্য সব খাতে যে খরচ হয়, তার প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয় শুধু ওষুধের পেছনে।

ওষুধ বিক্রেতারা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পর কয়েক দফায় বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট বাড়ানো হলে অতিরিক্ত অর্থ ক্রেতার পকেট থেকেই যাবে। ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বিভিন্ন ওষুধের দাম। তার আগেও বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে। অবশ্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর তখন বলেছিল, এই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বছরখানেক আগের। সেটি সমন্বয় করা হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর জানিয়েছে, এখন তারা মাত্র ১০টি ওষুধের দাম বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে।

তবে বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে পাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র। ফার্মেসির বিক্রেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ইনফেকশন নিরাময়ের ওষুধের দাম বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ওষুধের দাম বাড়াতে হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে অনুমোদন নিয়ে তারপর বাড়াতে হয়। তবে নতুন ভ্যাট আরোপের পর সেটি কীভাবে আদায় হবে তা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, ওষুধ কোম্পানির বাড়তি খরচ কমিয়ে ওষুধের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কাজ করা হচ্ছে।

এর আগে গত সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। সেখানে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।

সভায় অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন এবং রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখে ওষুধ। একসময় আমরা ৮০ ভাগ ওষুধ আমদানি করতাম, এখন দেড়শ’র বেশি দেশে আমাদের ওষুধ রফতানি করি। কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে গিয়ে রোগীরা যত খরচ করে, তার বেশিরভাগই যায় ওষুধের পেছনে। এজন্য আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য কাঠামো তৈরি করতে চাই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক বলেন, ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের। তাদের নিয়ম কোনো কোম্পানি মানে না। এমনকি তারাও মানতে বাধ্য করতে পারে না। তাই মাঝেমধ্যে মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে। এতে বিক্রেতা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, এমনিতেই হতদরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। এখন ওষুধের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায় দেখা দেবে চিকিৎসা বৈষম্য।

কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে