মনপুরার দু:খগাঁথা নিয়ে নৌপরিবহন উপদেষ্টার ক্ষোভ, লঞ্চঘাট আধুনিকায়নে একগুচ্ছ উদ্যোগ

প্রকাশিতঃ 10:05 pm | January 18, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

সবুজ শ্যামল ঘেরা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি রূপালী দ্বীপ মনপুরা। ভোলা জেলার মূল ভুখণ্ড থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন! এখানে নদী আর সাগরের মিতালীর অপরূপ সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে। মাইলের পর মাইল বৃক্ষের সবুজের সমাহার যেন ক্যানভাসে আঁকা শিল্পীর নিপুণ হাতে ছোঁয়া। যেখান থেকে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের দৃশ্য উপভোগ করাসহ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখতে পর্যটকেরা ভিড় জমায়। তবে আক্ষেপের বিষয় মনপুরায় মেঘনা নদীর ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হয়নি আজও। পতিত সরকারের সময়ে নদীর এক পাশে জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করলেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই।

পুরো বিষয়টি নজরে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড.এম সাখাওয়াত হোসেন এর। শনিবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুরে ভোলার মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট ঘাট পরিদর্শনের পর স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ‘সাগর কন্যা’ খ্যাত এই উপজেলার দু:খগাঁথা নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা। মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছেন, ‘বিগত সরকারের আমলে বিচ্ছিন্ন মনপুরা উপজেলায় নদীভাঙন বন্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়েছে। কিন্তু এখনো মনপুরায় নদীভাঙন প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।…এই দেশের কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এই টাকাগুলো দেশে থাকলে দেশ অনেক উন্নত হতো। এখন কোনো উন্নয়ন করতে গেলে চিন্তা করতে হয়। দুর্নীতি তাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।’ এজন্য আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন উপদেষ্টা।

জানা যায়, দু’দিনের সরকারি সফরে বর্তমানে ভোলায় রয়েছেন নৌপরিবহন ও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে আধুনিক লঞ্চ ঘাট ও জেটি প্রকল্পের স্থান পরিদর্শনে টানা দু’দিনই সেখানে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন উপদেষ্টা। সফরের প্রথম দিন শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) বিকেলে ভোলার দৌলতখান উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লঞ্চঘাট, তজুমদ্দিন উপজেলার চৌমুহনী লঞ্চঘাট ও লালমোহন উপজেলার বাত্তিরখাল লঞ্চঘাট পরিদর্শন করেন তিনি। এ সময় তিনি নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধের পাশাপাশি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ ও কোস্টগার্ডকে যৌথভাবে কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করেন।

আগামী দিনে চোরদের নির্বাচিত না করার পরামর্শ
সফরের দ্বিতীয় দিনে শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল ১০টার দিকে মনপুরা উপজেলার কলাতলী ইউনিয়নের ঢালচরে নতুন একটি লঞ্চঘাটের উদ্বোধন করেন উপদেষ্টা ড.এম সাখাওয়াত হোসেন। পরিদর্শন করেন একই উপজেলার রামনেওয়াজ ঘাট। পরে উপজেলার হাজিরহাট ঘাট পরিদর্শনের পর স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো আর বেশি দিন নেই। আগামী নির্বাচনে কোনো চোরদের নির্বাচন করিয়েন না। আপনারা সব দেখেছেন এবং জানেন। আমার দুঃখ লাগে, এই দেশের কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এই টাকাগুলো দেশে থাকলে দেশ অনেক উন্নত হতো।’

একটি দেশে উন্নয়ন বলতে কেবল শহরের রূপান্তরকেই বুঝায় না। উন্নয়ন শব্দটি গ্রামের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ‘উন্নয়ন’ শব্দটিকে ব্যবহার করে কেবলই নিজেদের আখের গুছিয়েছে বিগত সরকার। উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রান্তিক অঞ্চল থেকেছে বঞ্চিত আর অবহেলিত। ভোলা সফরকালে এই বৈষম্য দৃষ্টিতে এসেছে নৌপরিবহন ও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এর। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সার্বিক ব্যবস্থা ও সেবার মানে কোন উন্নতি পরিলক্ষিত না হওয়ায় প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন বলতে যেটা বোঝায়, সেটি হচ্ছে প্রান্তিক অঞ্চলের উন্নয়ন। বিগত দিনে প্রান্তিক অঞ্চলের উন্নয়ন হয়নি। বিগত সরকারে যারা ছিল, তারা নিজেদের মধ্যে টাকা লুটপাট করার জন্য বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাই প্রান্তিক অঞ্চলের উন্নয়ন হয়নি। ফলে দেশেরও উন্নয়ন হয়নি।’

ভোলার লঞ্চঘাট আধুনিকায়নে একগুচ্ছ উদ্যোগ
ভোলার প্রধান সমস্যা নদী ভাঙন। বর্ষা মৌসুমে সমুদ্র উত্তাল থাকে। নদী পারাপারে স্থানীয় জনসাধারণের নানাবিধ সমস্যার মুখে পড়তে হয়। ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয় নদী। এখানে যাত্রীসেবার মান নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। সরকার গিয়ে সরকার এলেও লঞ্চঘাটগুলোর সমস্যা সমাধানে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোন উদ্যোগ। ভোলার লঞ্চঘাটগুলোকে মানসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি এসব লঞ্চঘাটে যাত্রী ছাউনি থেকে শুরু করে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘ভোলার চারপাশে নদী। এই দ্বীপ জেলা ভোলায় যে ঘাটগুলো আছে, তা মানসম্পন্ন ও পর্যাপ্ত নয়। ঘাটগুলোতে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভোলায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেশ কিছু ঘাটের পুন:নির্মাণ করা হচ্ছে। ভোলার লঞ্চঘাটগুলোতে যাত্রীছাউনিসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। যাতে ঝড়-বৃষ্টিতে লঞ্চের যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে না হয়।’

মতবিনিময় সভায় ও ঢালচরে লঞ্চঘাটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাবেক জ্বালানি সচিব মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা, ভোলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আজাদ জাহান, মনপুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পাঠান মোহাম্মদ সাইদুজ্জামান, মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান কবির, উপজেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন বাচ্চু চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

লঞ্চঘাটগুলোতে অরাজকতা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা
যাত্রীদের জিম্মি বানানোর ‘উৎকৃষ্ট’ উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে ওঠে এসেছে বিভিন্ন লঞ্চঘাট। দেশের লঞ্চঘাটগুলোতে ইজারা নিয়ে অনিয়মের ঘটনা, স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব ও নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ঘাটগুলো নিয়ন্ত্রণে ইজারাদার ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা মিলে গড়ে ওঠেছে একটি চক্র। এই চক্রই ঘাটগুলোকে ঘিরে অরাজকতা তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। এমন সব অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলেছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা। শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) বিকেলে ভোলার দৌলতখান উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লঞ্চঘাট, তজুমদ্দিন উপজেলার চৌমুহনী লঞ্চঘাট ও লালমোহন উপজেলার বাত্তিরখাল লঞ্চঘাট পরিদর্শনকালে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা যত দিন আছি, তত দিন লঞ্চঘাটগুলোতে অরাজকতা সৃষ্টি হতে দেব না। লঞ্চঘাটগুলোতে যে অরাজকতা হয়, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

‘ভবিষ্যতে যারা সরকারে ক্ষমতায় আসবে, আশা করি তারা অতীত থেকে শিক্ষা নেবে’- এমন মন্তব্য করে তিনি সেদিন আরও বলেন, ‘ঘাটের ইজারাদারদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাঁচ টাকার ঘাটের টিকিটের স্থানে ১০ টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এ বিষয়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। কেননা এখন আর আগের সেই স্বৈরাচারী সরকার নেই। স্বৈরাচারী সরকারের সময় যা খুশি তা করেছে, সেটা যেন এখন আর না হয়।’

কালের আলো/এমএএএমকে