এক বছরে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

প্রকাশিতঃ 10:25 pm | January 18, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

দেশে ২০২৪ সালে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে ৩১০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ১৮৯ জনই নারী শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ১ শতাংশই মাধ্যমিক স্তরের। আত্মহত্যা করা সিংহভাগ শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে আচঁল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার (১৮ জানুয়ারি) ভার্চুয়ালি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

এর আগে ২০২২ সালে ৫৩২ জন এবং ২০২৩ সালে ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। সেই হিসাবে ২০২৪ সালে আত্মহত্যার হার কম। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আত্মহত্যা সম্পর্কিত প্রতিবেদন মিডিয়াতে কম এসেছে বলে মনে করছে আচঁল ফাউন্ডেশন।

সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের আত্মহত্যার তথ্য বিগত বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশে আত্মহত্যাকারী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫৩২ জন। ২০২৩ সালে ছিল ৫১৩ জন। ২০২৪ সালে আত্মহত্যাকারী মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩১০ জন। তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছেন।

প্রতিবেদনে বয়স ভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, ১৩ থেকে ১৯ বছরে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের শুরু থেকে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালে আত্মহত্যাকারীদের ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোর বয়সী। এরপরই রয়েছেন ২০ থেকে ২৫ বয়সীরা, প্রায় ২৪ শতাংশ।

শিশুদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা গেছে। এক থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুর আত্মহত্যার তথ্য উঠে এসেছে, যা প্রায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। সবচেয়ে কম রয়েছে ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সসীমার মানুষ, ২ দশমিক ৯ শতাংশের কাছাকাছি।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আত্মহত্যার প্রবণতা সব লিঙ্গের মধ্যে দেখা গেছে। তবে নারীদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি। আত্মহত্যা করা ৩১০ জনের মধ্যে নারী প্রায় ৬১ শতাংশ। পুরুষদের প্রায় ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তৃতীয় লিঙ্গের এবং ট্রান্সজেন্ডারদের মধ্যে একজন করে আত্মহত্যা করেছেন, যা মোট সংখ্যার শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ১ শতাংশ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী। এরপরই উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। এ হার ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। তথ্যমতে, ২০২৪ সালে এ পর্যায়ে আত্মহত্যার হার ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত বছর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ১ শতাংশ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের হার ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া প্রাথমিক স্তরে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝেও আত্মহননের বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। এ স্তরের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। স্নাতকত্তোর ১ দশমিক ৯ শতাংশ, ডিপ্লোমা শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, সদ্য পড়াশোনা শেষ করা শিক্ষিত তবে বেকারদের মধ্যে আত্মহত্যার হার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহননের ঘটনা সবচেয়ে বেশি, যা ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বিষপানে আত্মহত্যার হার প্রায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া ৪ দশমিক ৬ শতাংশ অন্যান্য পদ্ধতিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। যেমন-ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পানিতে ডুব দিয়ে, ট্রেনে কাটা পড়ে, ছুরি দিয়ে আঘাত, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ইত্যাদি।

২৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অভিমানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এরমধ্যে প্রাথমিক স্কুল শিক্ষার্থী ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষার্থী ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং উচ্চতর শিক্ষা স্তরের ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশেও আত্মহত্যা একটি ক্রমবর্ধমাণ সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠেছে। সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ এবং ঘৃণার চোখে দেখা হলেও প্রতি বছরই আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ অপসংস্কৃতির প্রভাব খুব বেশি। প্রতি বছরের মতো এ বছরও আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস ইউনিটের’ সদস্যরা দেশের জাতীয় ও স্থানীয় ১০৫টিরও বেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত আত্মহত্যার সংবাদের তথ্য খুঁজে পায়।

আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে আনতে বেশকিছু সুপারিশ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। সেগুলো হলো– শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবী অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ করা; বন্ধু সহযোগিতা গ্রুপ তৈরি করা; দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নিয়মিত কর্মশালা করা; শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ফিলিংস অ্যালার্ম সিস্টেম চালু করা; পারিবারিক কাউন্সেলিং করা; সৃজনশীল থেরাপি ক্লাস ও ডিজিটাল মেন্টাল হেলথ ক্যাম্পেইন করা।

সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত ছিলেন– বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সায়্যেদুল ইসলাম সায়েদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. জামাল উদ্দীন, আইনজীবী ও লেখক ব্যারিস্টার নওফল জামির, আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।

কালের আলো/এমডিএইচ