সেনা-জনতা একাট্টায় জাতীয় ঐক্য ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সোনালী সময়

প্রকাশিতঃ 6:44 pm | January 19, 2025

মোস্তফা কামাল:

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকেন্দ্রিক ভবিষ্যতের উদ্দেশে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভালো কিছু উদ্যোগের প্রশংসা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ। প্রশংসার সঙ্গে ‘কিন্তু’ যোগ করে বলেছে, ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া ঐক্যের অগ্রগতি ম্লান হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থাটি তাদের ২০২৪ সালের ৫৪৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে বলেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করা উচিত। বিশ্ব স্বীকৃতির তাগিদও দেয়া হয়েছে।

পুলিশ, প্রশাসনসহ প্রাতিষ্ঠানিক বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারে ঘাটতি নিয়ে কথা হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি অঘোষিত ঐক্য ও আকাঙ্খা জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। সেইসঙ্গে তাদের মধ্যে আর চুপ না থেকে মুখ খুলে কথা বলার চর্চা শুরু হয়েছে। পদক্ষেপও নিয়ে ফেলছে। যার কিছু নমুনা গত ক’দিন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায়। যেখানে প্রতিবেশি দেশের কাঁটাতারের বেড়া বা কোনো ধরনের আগ্রাসন টের পাচ্ছে সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির সাথে। এ এক অন্যরকম আবহ। জাতীয় ঐক্যের এক বিস্ময়কর মহড়া।

খুব লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সীমান্তে ভারত যত উত্তেজনা সৃষ্টি করছে বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের ভুখন্ড রক্ষায় ততবেশি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। বিজিবি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের শক্ত অবস্থানের কারণে ভারত সীমান্তের নানা জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যোগ হয়েছে বিজিবি এবং স্থানীয় নাগরিকদের একাট্টায় দেশত্ববোধের আরেক মাত্রা। ভারতের সাথে ‘নতজানু’ পররাষ্ট্রনীতি নয়, বরং ‘সাম্যতার ভিত্তিতে’ সরকারকে তা ঠিক করতে প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানিয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্যরা। এর ফল মিলছে। সীমান্তে পীঠ দেখানোর দিন শেষ, বিএসএফকে বুক দেখানো শুরু হয়েছে। একটি অপশক্তির বিদায়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তা বড় রকমের পাওয়া। সামরিক – বেসামরিক শক্তি এক হলে দেশি-বিদেশি কোনো অপশক্তি বাংলায় আর সুবিধা করতে পারবে না- জনতার এ বার্তা পরিস্কার।

নিরাপত্তার আধুনিক সংজ্ঞায় ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বলতে কিছু নেই। প্রবল জনঐক্য, সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি আস্থা ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই আসল কথা। জরুরি প্রয়োজন এখন সামরিক এবং বেসামরিক শক্তির এ সেতুবন্ধন অটুট রাখা। ইতিহাসের কথা এখানে স্মরণ করতে হয়। ‘বাংলাদেশ রক্ষা করতে হলে বেসামরিক এবং সামরিক শক্তি একসাথে কাজ করতে হবে’- মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একথাগুলো বলেছিলেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের অব্যবহিত পরে সামরিক নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জননেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে উদ্দেশ্য করে। এই ফর্মুলার কারণে ভারতের আধিপত্যবাদি শক্তি সেসময় পরাজিত হয়েছিল। পরে রাজনৈতিক নেতারা সময়ে সময়ে সামরিক বাহিনীর গুরুত্ব বুঝতে অনীহা করেছে। যার পরিণতিতে আধিপত্যবাদি শক্তির সঙ্গে মিতালি হয়েছে ফ্যাসিবাদের। অবিরাম ভুগতে ভুগতে হুঁশ ফেরে চব্বিশে এসে।

২০২৪ সালের জুলাই আগস্ট মাসে অকুতোভয় ছাত্রদের নেতৃত্বে বিপ্লবে শরীক হলো জনতা। এগিয়ে এলো সেনারাও। ম্যাজিকের মতো আধিপত্যবাদী শক্তি এবং ফ্যাসিবাদ কেবল হটেইনি। গোরমুখীও হলো। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের এ সম্পর্কটা টং দোকানের সম্পর্ক নয়। এর ভিত্তি তৈরি হয় একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে। সময়ে সময়ে এ সম্পর্কে চির ধরিয়েছে দেশি-বিদেশি অপশক্তি। চব্বিশের ঘটনা তাদের আবার একাট্টা করেছে। সেনা-জনতার শক্তির শক্ত সেতুবন্ধনে আবার ফিরেছে বাংলাদেশ। সেই বার্তা সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বয়ানেও মিলেছে। ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘দেশ ও জাতি গঠনের বিভিন্ন কাজে আমরা নিয়োজিত আছি। ইউএন মিশনে বিশ্ব শান্তিরক্ষায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণেও কাজ করছি এবং আমরা পারদর্শিতা অর্জন করেছি।’

সেনা প্রধানের ওই বার্তার দিন তিনেকের মধ্যেই জাতীয় ঐক্যের ডাক প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের। ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসস্থ ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ কমপ্লেক্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স ২০২৪ এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স ২০২৪ এর কোর্স সমাপনী অনুষ্ঠানে সার্টিফিকেট প্রদান শেষে তিনি বলেন: “বর্তমানে বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন”। এরপর তিনি সংলাপ শুরু করেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। এর কয়েকদিন পর ঢাকার বাইরে রাজবাড়ীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক ব্রিগেড গ্রুপের শীতকালীন ম্যানুভার অনুশীলন অনুষ্ঠানেও প্রধান উপদেষ্টার কয়েক লাইন বক্তৃতার মাঝেও ছিল স্পষ্ট ও সুক্ষবার্তা। সেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের সম্মান ও গৌরব রক্ষায় জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনী, জনগণ এবং ড. ইউনূস একত্রে কাজ করলে দেশের ইমেজের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যে হতে বাধ্য তা বুঝতে বিশাল বুদ্ধিজীবী হওয়া লাগে না। সেনানিবাস থেকে জাতীয় ঐক্যের ডাক আর যমুনা থেকে সংলাপের বিশেষ গুরুত্ব সচেতন মহল আঁচ করছেন ভালোভাবে। আধিপত্যবাদী শক্তি ও তাদের খাস পছন্দের শক্তি তা বোঝে আরো আগে। জেনারেল ওয়াকার তো জানিয়েই দিয়েছেন, ‘২০২৫ সালে আমরা একটা দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে যেতে চাই। সে জন্য সবাইকে একসঙ্গে চলতে হবে’।

এমন স্পষ্ট বার্তার পর বোঝার আর অবশিষ্ট থাকে না। জাতীয় স্বার্থে এমন ঐকমত্য থাকলে কেবল গণতন্ত্রই স্থায়ী নয়, সংস্কার প্রশ্নে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিশ্ব স্বীকৃতির বিষয়েও নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। তখন নিশ্চয়ই দেশে ফ্যাসিস্ট সৃষ্টির পথ বন্ধ হবে। জন্ম নেবে না আরেকটা শেখ হাসিনা, আজিজ, তারিক, বেনজীর, হারুণ ইত্যাদি। ভোটবিহীন, নৈশ এবং ডামি নির্বাচনে আপ্লুত হওয়ার রোগ থাকবে না। এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ির সিসি, রাজউকের প্লটের সাইজ বাড়বে না। অবসর থেকে ডেকে এনে গাড়ি-বাড়ি-বেতন- ভাতা দিয়ে চুক্তিতে কাউকে আনতে হবে না। ‘চোরের খনি’ খনন বন্ধ হবে। রসেবশে তেলেঝোলে পুষ্পদর্শনে লালায়িতদের যবনিকা ঘটবে। মোটকথা মানুষ যে-কারণে অতিষ্ঠ হয়ে ছাত্রদের এক ডাকেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল, সেই কারণগুলো দূর হবে।

সামনে নির্বাচন অপেক্ষমান। নির্বাচন নিয়ে জনমনে আকাঙ্খার সাথে উদ্বেগ রয়েছে। শার আলোও ফুটে উঠছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সেনাবাহিনীর সহায়তায় একটি সুষ্ঠু, অবাধ, এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, সেনাবাহিনীর ভূমিকার যৌক্তিকতা, এবং এর সম্ভাব্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেনা সহায়তায় সুষ্ঠু নির্বাচনের উদাহরণে মিশরের কথা আসে। ২০১৪ সালে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনে সেনাবাহিনী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সেনাবাহিনীর সহায়তায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। সেখানে সেনাবাহিনী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত এবং নির্ভুল নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেছে। কিন্তু, রাজনৈতিক কারসাজিতে অস্থিরতা কাটানো যায়নি।

সেনাবাহিনীর সহায়তায় সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশেও রয়েছে। মাঝেমধ্যে তা বরবাদ করেছে রাজনৈতিক কুশক্তি। এখন দিন অনেকটা বদলে গেছে। সেনা সহায়তা বললে তাদের পাশে সহায়তায় নেমে যাবে সাধারণ মানুষও। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্কটা এখন ওই পারদেই পৌঁছেছে। সেইসঙ্গে সেনাবাহিনী সবসময় একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। তারওপর ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনী সামগ্রী পরিবহন এবং ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রমাণিত। জনগণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো একে সহযোগিতা করলে সেনাবাহিনীর ভূমিকা গণতন্ত্রের সহায়ক হয়, শাসক নয়-তা চব্বিশে বাংলাদেশে টাটকা উদাহরণের মতো দেখলো বিশ্বাসী।

এখানে ভূ-রাজনীতি ও বিশ্ববাস্তবতাও একটা ফ্যাক্টর। এর বাইরে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শাসক নানা ক্রিয়াকর্মে নিজেও তার নিজের পতন দ্রুত নিশ্চিত করেছে। যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশকে এগিয়ে যাবার সময় ও পথ রচনা করে দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের থাবা ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানকার শাসক গোষ্ঠী রাজনৈতিক কারণে এ অবস্থায় এনে ছেড়েছে দেশটিকে। এখন এর জের ভুগতে হচ্ছে গোটা ভারতকে। বলিউড অভিনেতা সাইফ আলী খানকে অজ্ঞাত এক যুবকের ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত অবস্থায় মুম্বাইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। এ ঘটনায় ভারতের নিরাপত্তাবাহিনী, হিন্দুত্ববাদী উগ্র সংগঠন লরেন্স বিশ্নোই গ্যাংয়ের যোগসূত্রসহ অনেক বিষয় সামনে আসছে। হামলার টার্গেটে হয়ে আছেন শাহরুখ খানও। এর আগে সালমান খানকে গুলি, পাঞ্জাবি গায়ককে হত্যাসহ বেশকিছু ঘটনার পেছনে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও মাফিয়া গ্যাংদের সম্পৃক্ততার জেরে ভারতে শোরগোল পড়ে যায়। ভারত বাংলাদেশেও এ রকম একটা অবস্থা করার হেন চেষ্টা নেই, যা না করেছে। তাদের এই অপচেষ্টা চরমভাবে ভণ্ডুল হয়েছে।

এখানে উগ্র মৌলবাদী শক্তির উত্থানের তকমা লাগিয়ে অপপ্রচারে লিপ্তরা এখন এসব ঘটনায় নিশ্চুপ। এ পথে ব্যর্থ হয়ে তারা এখন অপেক্ষমান সীমান্তে খোঁচাখুচির। সেখানেও সীমান্তবাসীসহ বাংলাদেশের মানুষের অন্য উচ্চতার সতর্কতা ও ভূমিকা ইতিহাস হয়ে থাকবে। জানুয়ারি বিশে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শপথ নিলে ভারতের সমর্থনে ফ্যাসিস্টরা মাঠে নেমে অন্তবর্তী সরকারের গদি উল্টে দেবে, সেনা-জনতার রসায়নে অর্জিত অভ্যুত্থান বুমেরাং করে দেবে, সেই আশায় অপেক্ষমানরাও চুপসে গেছে। এ পরিস্থিতে সেনা-জনতা-ছাত্রসহ সব মহলের জাতীয় ঐক্য ও বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার এক সোনালী সময়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন