সুন্দর এক প্রজন্ম গড়ি, ভ্রুন থেকেই যত্ন করি

প্রকাশিতঃ 10:14 am | March 18, 2019

নাছিমা আক্তার ::

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আশরাফুল মাখলুকাত। মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু প্রানীকুলের মাঝে মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনাবোধ, মাত্রাজ্ঞান, পরিমিতিবোধ, আত্মসংযম, পরার্থপরতা, সহযোগিতা, সমমর্মিতা, সমানুভূতি সব কিছু মিলিয়েই।

জীবন এক নিরবচ্ছিন্ন বহমান প্রক্রিয়া। জীবন সময়ের সমষ্টি। এ সময় অনন্ত। সকল ধর্মই স্বীকার করে পৃথিবীতে মানব শিশু রূপে আভির্ভূত হবার পূর্বেও একটা জীবন ছিল । আবার পৃথিবী থেকে থেকে চলে যাবার পরও জীবন চলে যাবে সময়ের অন্য এক ভিন্ন মাত্রায়।পবিত্র কোরানে আল্লাহ পাক বলেছে “ সময়ের প্রতিটি মূহুর্ত নব নব রূপে দীপ্যমান”। তাই জীবন পরিক্রমা মহাজাগতিক এক সফরসফর। মহাকালের এই জীবন পরিক্রমায় দেহের ভেলায় চড়ে পৃথিবীতে মানবাত্মার কিছুকাল অবস্থান। এ অবস্থানও আবার বহতা নদীর মত। মানবাত্মার দেহ ধারন করে এই পৃথিবীতে অবস্থান কালীন সময়ে এমনকি ভূমিষ্ট হবার পূর্ব থেকেই তার ধাপে ধাপে ঘটতে থাকে ‘বিকাশ’।

পৃথিবীর সকল প্রাণীর শিশুসত্তা জন্মের পরপরই উঠে দাঁড়ায়, খাবার তুলে খায়, হেঁটে বেড়ায় এবং নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। কিন্তু মানব শিশুর এ কাজগুলো করতে সময় লাগে এক থেকে দেড় বছর। তাই মানুষকে মানুষ করে তুলতে হয় ভ্রুন থেকে শুরু করে সময়ের প্রতিটি ধাপে সঠিক যত্মায়নের মাধ্যমে। আর সেজন্যই যত্মায়নের শুরু ভ্রুন থেকে, শেষ কবরে।

মানুষ পরিবার ও সমাজবদ্ধ প্রাণী। সে পরিবারে জন্মায় , পরিবার ও সমাজে বেড়ে উঠে। পরিবার এবং সমাজই তার শেষ কৃত্য সম্পাদন করে। পরিবার এবং সমাজ তাই মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। এর বাইরে যেয়ে কেউ কখনো প্রকৃত সুখী হতে এবং সত্যিকারের সাফল্য অর্জন করতে পারে না।

১৯৯০ সাল থেকে শিক্ষকতা পেশায় কাজ করছি। স্বভাবজাত কোন এক অজ্ঞাত প্রেরণা বা তাড়না থেকেই শিক্ষার্থীদের মনোসামাজিক, ও মনোদৈহিক সমস্যাগুলো খুব সহজেই ধরা দেয় মনের ক্যানভাসে। ভাবি, চিন্তা করি, সময় দেই, মমতা দেই, ভালোবাসি, কাছে টানি। আর ভেতরের কষ্টগুলোকে, সমস্যাগুলোকে, ভ্রান্ত বিশ্বাসে আবদ্ধ হয়ে যুগযন্ত্রণার শিকার এই ছোট ছোট ফুলের মত শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক সমস্যা সমাধানের চিন্তায় অস্থির হই। কাজ করতে করতে প্রায়শই মনে হয় এই যুগযন্ত্রণা শুরুটার শুরু কোথায়? ভেতর থেকেই তাগিদ পাই এই নিয়ে কিছু লেখার, কিছু করার। এই লাইনে পড়াশুনার সুযোগ খুবই কম তবুও শিক্ষার্থীদের সুন্দর মনন গঠনে কিছু একটু করার চেষ্টাই এই লেখাটির সাহস যুগিয়েছে আমাকে।

বেশ ক’ বছর আছে ইউনিসেফ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর যৌথ ব্যবস্থাপনায় এক প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “গর্ভ থেকে পাঁচ/বুদ্ধি বলে বাড়তে আমায় যত্ন করো আজ”। দেখা যায় আমাদের বেশিরভাগ সন্তান পৃথিবীতে আসে অকস্মাৎ এবং অপরিকল্পিতভাবে। বিবাহ এবং সন্তান জন্ম দেয়া নিয়ে সুচিন্তিত, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, সঠিক জ্ঞান ও সঠিক পরিকল্পনা থাকে না। কিন্ততু থাকাটা অত্যন্ত জরুরী।

বিজ্ঞান প্রমান করছে যে, শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় মা কাজের ফাঁকে আপন মনে গুন গুন করে যে গান গেয়ে থাকেন, জন্মের পর সেই গান গেয়ে ঘুম পাড়ালে শিশু খুব সহজেই ঘুমিয়ে যায়। শিশু গর্ভে ৭-৮ মাস বয়স হলে পিতার কন্ঠস্বর চিনতে পারে এবং সাড়াও দিতে পারে।ইহুদি নারীরা গর্ভবতী হলে জটিল জটিল গণিত সমাধান করে থাকে। য়ার তাই দেখা যায় পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্যের বিরাট একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ইহুদীরা।
সুতরাং আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতেই পারি যে সোনার বাংলা সোনার মানুষে ভরে দিতে হলে এবং দেশের জন্য মহান এক প্রজন্ম পেতে হলে আমাদের সূদূর প্রসারী প্রজ্ঞাপূর্ণ পরিকল্পনা প্রনয়ণ করতে হবে। এবং এটি হতে পারে গর্ভবতী মায়েদের জন্য এমন কি পিতা মাতা হবার উপযুক্ত বয়সীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ।

বর্তমান সরকার মানব সম্পদ উন্নয়নে বেশ কিছু চমৎকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে দেশে-বিদেশে, GO, NGO –এর মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করেছেন । আজকাল বহু কোর্স অনলাইনেও দেয়া আছে।

আমি মনে করি এই মূহুর্তে সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত, প্রজ্ঞাপূর্ণভাবে একটি প্যারেন্টিং কোর্স প্রণয়ন করে তা নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ এবং সমমান পর্যায়ে কোন আবশ্যিক বিষয়ের সাথে জুড়ে দেয়া যেতে পারে। সন্তানের জন্ম নিয়েও আমাদের থাকতে হবে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সূদূর প্রসারী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞাপূর্ণ পরিকল্পনা।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেও দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মে সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় মাকে সৎচিন্তা করা, সৎকর্ম করা, ভালো বই, মহামানবদের জীবনী পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে।
বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, তিনি মাতৃগর্ভ থেকে কয়েক পারা কোরআন মুখস্থ করে জন্মেছেন।

আমার বেশ কিছু পর্যবেক্ষন আছে যে যেসব মেয়েরা লেখাপড়ায় থাকা অবস্থায় বিয়ে ও সন্তানের মা হয়ে যায় তাদের সেই সন্তান খুবই মেধাবী হয়েছে। কারণ সন্তান গর্ভে নিয়ে তারা প্রচুর পড়ালেখা করেন যা তার গর্ভেস্থিত সন্তানের মেধা ,বুদ্ধিমত্তা গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় মায়ের চিন্তা- চেতনা, কার্যক্রম, বিশ্বাস , লালিত অভ্যাস ভ্রুন তথা গর্ভস্থিত সন্তানের বৈশিষ্ট্য গঠনের সরাসরি প্রভাবিত করে

যদি জন্মের পূর্ব থেকেই একজন দম্পতি শারিরীক-মানসিকভাবে সুস্থ্য থেকে সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করে সন্তান নিতে পারেন এবং সন্তান গর্ভে থাকাকালীন গর্ভবতীর সঠিক যত্মায়ন নিশ্চিত হয় তাহলে অবশ্যই গর্ভস্থিত শিশু শারিরীক, মানসিক, আবেগিক ভাবে সুস্থ্য হবে, প্রাণ-প্রাচুর্য্যে, মেধা-মননে, বিবেক-বিবেচনায় একজন আদর্শ মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে।

একজন গর্ভবতী তার গর্ভস্থ শিশুর সঠিক পরিচর্যা করবেন নিজের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের জন্য সুসন্তান, সুনাগরিক উপহার দিতে, আর এ জন্য সমাজে সচেতনতাও তৈরী করতে হবে ব্যাপকভাবে।গর্ভবতীর স্বামী এবং আত্মীয় স্বজনকেও বুঝতে হবে বংশধর কীর্তিমান, মহীয়ান পেতে চাইলে গর্ভবতী মাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টির ব্যবস্থা করার পাশাপাশি মানসিকভাবে প্রফুল্ল রাখা, নিরাপত্তা সুখ, আর প্রশান্তির বলয়ে রাখাটা জরুরী।

সচরাচর বিয়ের মাধ্যমে একটি মেয়েকে নিজ পরিবার ছেড়ে স্বামীর পরিবারে যেয়ে বসবাস করতে হয়। এ যেন একটি বাগানে বেড়ে উঠা গাছকে মাটি থেকে তুলে অন্য বাগানে রোপন করা। সে ক্ষেত্রে গাছটিকে বাঁচিয়ে তুলতে যেমন প্রয়োজনীয় সার, পানি, ছায়া এবং মমতা প্রয়োজন ফুলে-ফলে, পুষ্প, পল্লবে বিকশিত হতে।

ঠিক তেমনি এক পরিবেশ থেকে হঠাৎ করে একেবারে ভিন্ন আরেক পরিবেশে,অন্যরকম চিন্তা-চেতনায় ভিন্নরকম অন্য একটি পরিবারে মানিয়ে নিতে, সেই পরিবারের একজন হয়ে উঠতে নববধুকে দিতে হবে সময়, মমতা। বাড়িযে দিতে হবে সমানুভূতির হাত। মেলে দিতে হবে হৃদয়। আর সেই হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশেই আপনবোধ জাগ্রত হবে নববধুর। নববধু মনে করবে এ এক অভিনব নতুন আলয়, নতুন ভূবন। নিজের মধ্যে অনুভূত হবে এক অন্যরকম ‘আমি’ সত্তা।

আর সেই আমি সত্তায় যখন নতুন মানব শিশুর অস্তিত্ব অনুভব করবে তখন তার সমগ্র সত্তায় সুখানুভূতি প্রবাহিত হবে। দেহের প্রতিটি কোষ তখন সেই ক্ষুদ্র অস্তিত্বকে পরিপূর্ণ সুন্দর এক মানব শিশু সৃষ্টির কাজে লেগে যাবে অবলীলায়, ভূমিষ্ট হবে সে শারিরীক, মানসিক, চেতনাগত, বুদ্ধিগত ভাবে পরিপূর্ণ এক অনন্য মানুষরূপে।

জন্মের পর থেকে জীবনের প্রতিটি পর্বে ধাপে ধাপে সঠিক যত্নায়নের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে সে দেশ ও সমাজের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক অসাধারণ ব্যাক্তিরূপে।
আর তাই এই মূহু্র্তে সুপরিকল্পিত একটি প্যারেন্টিং কোর্স এখন সময়ের দাবী। (চলবে)

লেখক: প্রধান শিক্ষক, বিদ্যাময়ী সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।