ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট’ হলেন সেনাপ্রধান, যুদ্ধ উপযুক্ততা বৃদ্ধির চলমান প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান করার অঙ্গীকার

প্রকাশিতঃ 9:28 pm | January 23, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

সেনাবাহিনীর পদাতিক বাহিনীর সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ইউনিট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ নানা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে দেশের প্রথম এই রেজিমেন্টের। দীর্ঘ ৭৬ বছরের ঐশ্বর্যময় পথচলার ইতিহাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবার পেয়েছে নতুন অভিভাবক। বর্ণাঢ্য সামরিক রীতি অনুসরণ করে বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (ইবিআরসি) এর শহীদ এম আর চৌধুরী প্যারেড গ্রাউন্ডে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র ১৭তম ‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট’ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

তিনি রেজিমেন্টের সদস্যদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেছেন। আধুনিক সরঞ্জাম যুক্ত হওয়ায় সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন। দেশের যেকোন কল্যাণে রেজিমেন্টের সকল সদস্যের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আভিযানিক সক্ষমতা বাড়িয়ে যুদ্ধ উপযুক্ততা বাড়ানোর চলমান প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান করারও দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন। আশাবাদী উচ্চারণে সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নানামুখী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে।’

সেনাবাহিনীর মূল চালিকাশক্তি, প্রাচীনতম, ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আদ্যোপান্ত
জানা যায়, সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো কোন ইউনিটের ‘কর্নেল কমান্ড্যান্ট’ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মূল চালিকাশক্তি, প্রাচীনতম, ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৭তম কর্নেল ‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট’ হিসেবে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ’র স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মেজর আবদুল গণি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল পদাতিক ব্রিগেডেই এই রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন রয়েছে। সম্মুখ যুদ্ধে শত্রুকে প্রতিহত ও পরাজিত করাই এই রেজিমেন্টের মূল দায়িত্ব। বৈশ্বিক শান্তি-রক্ষায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারও বাস্তবায়ন করছে তাঁরা।

  • বিগত কয়েক বছরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন সাধিত
  • আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র সরঞ্জাম জোগান দেওয়ার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকার বার্তা
  • দেশের প্রয়োজনে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকার নির্দেশ
  • ইন্ডিজেনাস ডিফেন্স ইন্ডাষ্ট্রি তৈরির কার্যক্রমের সুসংবাদ

সকল কর্নেল কমান্ড্যান্ট ও পাপা টাইগার্সসহ সকল সাবেক সদস্যদের দূরদর্শিতা, নিরলস পরিশ্রম ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই রেজিমেন্ট এখন সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। ‘সৌম্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা’- এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত এই রেজিমেন্ট উৎকর্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৯ সালে ‘জাতীয় পতাকা’ লাভের দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছে। কঠোর পরিশ্রম, সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও দেশপ্রেমের দৃঢ় অঙ্গীকারের মাধ্যমে নিজেদের আসীন করেছে এই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে। সাধারণত সেনাবাহিনীতে পদাতিক রেজিমেন্টই যুদ্ধের মূল বিজয় অর্জনকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে এই রেজিমেন্টের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের সঙ্গে সেনাবাহিনীর উন্নয়নও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এই রেজিমেন্টের ১৭তম ‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও যুদ্ধ উপযোগী ও আধুনিক প্রযুক্তির যেকোন প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র সরঞ্জাম জোগান দেওয়ার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকার কথা জানিয়েছেন।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শহীদ এম আর চৌধুরী প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছালে তাঁকে প্রচলিত সামরিক রীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে অভিবাদন জানানো হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি চৌকস দল প্রদান করেন গার্ড অব অনার। এরপর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জ্যেষ্ঠতম অধিনায়ক এবং জ্যেষ্ঠতম মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার সেনাবাহিনী প্রধানকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘কর্নেল র‌্যাংক ব্যাজ’ পরিয়ে দেন। পরে সেনাবাহিনী প্রধান উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে তাঁর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করেন। পরে তিনি ইবিআরসি’র কোয়ার্টার গার্ড পরিদর্শন করেন এবং স্মৃতি কানন প্রাঙ্গনে বৃক্ষরোপণ করেন।

‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট’ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে গর্বিত সেনাপ্রধান
শহীদ এম আর চৌধুরী প্যারেড গ্রাউন্ডে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র ১৭তম ‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট’ এর অভিভাবকত্ব গ্রহণের পর উচ্ছ্বসিত সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নিজের বক্তব্যের শুরুতেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাচীনতম, ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৭তম ‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট’ হিসেবে তাকে নির্বাচিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম রেজিমেন্ট। এই রেজিমেন্ট গঠনের পেছনে রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই রেজিমেন্ট ৮টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে গঠিত হয়েছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধে এই রেজিমেন্টের ১২ হাজার ৮৩৩ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন এবং ২৩১ জন সদস্য খেতাবপ্রাপ্ত হন। এর মধ্যে দু’জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৩৪ জন বীর উত্তম, ৭৪ জন বীর বিক্রম ও ১২১ জন বীর প্রতীক রয়েছেন। এছাড়াও এই রেজিমেন্টের ৯২৪ জন সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের আত্মোৎসর্গ করেন। আমি সকল শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পদাতিক বাহিনীর সবচেয়ে পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট’ হিসেবে দায়িত্ব নিতে পেরে আমি অত্যন্ত গর্বিত। আজকের এই প্যারেড অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর হয়েছে। আমি প্যারেডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

ইন্ডিজেনাস ডিফেন্স ইন্ডাষ্ট্রি তৈরির কার্যক্রমের সুসংবাদ
একনিষ্ঠ উদ্যোগের ফলে বিগত কয়েক বছরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এর মধ্যে নতুন নতুন ইউনিট প্রতিষ্ঠা, আধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জামাদিসহ বহু উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত হয়েছে’-বলে জানান সেনাপ্রধান। তিনি ইন্ডিজেনাস ডিফেন্স ইন্ডাষ্ট্রি তৈরির সুসংবাদও দিয়েছেন এদিন। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘আমি কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আভিযানিক সক্ষমতা ও যুদ্ধ উপযুক্ততা বৃদ্ধির চলমান প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান করবো ইনশাআল্লাহ। যুদ্ধ উপযোগী ও আধুনিক প্রযুক্তির যেকোন প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র সরঞ্জাম জোগান দেওয়ার ব্যাপারে আমি সর্বদা সচেষ্ট থাকবো। ইতোমধ্যেই আমরা ইন্ডিজেনাস ডিফেন্স ইন্ডাষ্ট্রি তৈরির কার্যক্রম শুরু করেছি। যা আমাদের সক্ষমতাকে অনেকাংশে বৃদ্ধি করবে।’

‘কর্নেল অব দি রেজিমেন্ট হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিটি সদস্যকে পেশাদার ও সুপ্রশিক্ষত হিসেবে গড়ে তুলতে আমি বদ্ধপরিকর’- উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি একটি সুন্দর জীবনমান আমাদের সকলের কাম্য। আমি যেকোন কল্যাণমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকবো। এ বিষয়ে আমি রেজিমেন্টের সকল সদস্যদের সহযোগিতা কামনা করছি। আমি আশা করবো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিটি সদস্য তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সর্বোচ্চ শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পালন করবে। এই রেজিমেন্টের প্রতিটি সদস্য দেশের যেকোন প্রয়োজনে স্বত:স্ফূর্তভাবে দায়িত্ব পালন করবে। প্রয়োজনে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকবে।’

আইএসপিআর আরও জানায়, অনুষ্ঠান শেষে সেনাবাহিনী প্রধান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩৭তম বাৎসরিক অধিনায়ক সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং এই রেজিমেন্টের উন্নয়ন, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও দেশে-বিদেশে পরিচালিত কার্যক্রমের বিষয়ে মতবিনিময় করেন। তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য এবং দেশ মাতৃকার সেবায় এই রেজিমেন্টের অবদানের কথা স্মরণ করেন। এছাড়াও তিনি আধুনিক যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সদা প্রস্তুত থাকতে রেজিমেন্টের সকল সদস্যের প্রতি আহবান জানান। অনুষ্ঠানে সেনাসদর, আর্মি ট্রেনিং এন্ড ডকট্রিন কমান্ড, স্থানীয় ফরমেশন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কালের আলো/এমএএএমকে