বিএনপিকে ছাত্রনেতাদের তোপ

প্রকাশিতঃ 10:32 am | January 24, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন’ এই ইস্যুতে প্রথম থেকেই অনড় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। বিপরীতে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবিতে সোচ্চার দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। মূলত এ থেকেই নিজেদের মধ্যে বাড়তে থাকে দূরত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারা যুক্ত করতে শিগগির নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন হতে যাচ্ছে ছাত্র নেতারা। রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির সমন্বয়ে এই দল গঠিত হতে যাচ্ছে। বিষয়টিকে বিএনপি ভালো চোখে দেখেনি বলে বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেছেন ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ। এরপর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, সংবিধান, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধসহ নানান বিষয়ে তৈরি হয় মতবিরোধ। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে একই লক্ষ্যে একসঙ্গে পথ চললেও এখন তাঁরা যেন কার্যত মুখোমুখি এক অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন।

বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি দলটির মহাসচিবের এহেন বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে আরেকটা ওয়ান-ইলেভেন সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে দাবি করেছেন। তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা ওয়ান-ইলেভেনের সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।’

  • বিএনপি মহাসচিবের দাবি আরেকটা ওয়ান-ইলেভেন সরকার গঠনের ইঙ্গিত
    নাহিদ ইসলাম
    উপদেষ্টা
    তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়

বিএনপি’র সঙ্গে তরুণদের মতভিন্নতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ’র ফেসবুক পোস্টে। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘জনগণের আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে গণঅভ্যুত্থানের পরে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা জনসমক্ষে উপস্থিত হলো। ঠিক এ কারণেই ফ্যাসিবাদবিরোধী ও জুলাই স্পিরিটকে ধারণকারী ছাত্র-জনতার সম্মিলনে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান হওয়ার আভাস পেয়ে বিএনপি সেটিকে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করলো।’ একটি জাতীয় দৈনিকের বরাত দিয়ে তিনি লেখেন, ‘ছাত্র-জনতার সম্মিলনে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন বানচাল করতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মাঝে উদ্বেগ ও শঙ্কা আদান-প্রদান হয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরায় আওয়ামী লীগকে অবাধ অনুপ্রবেশ করতে দিলেও নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান দেখতে চায় না।’

বিএনপির দিকে তীর ছুড়ে বিভিন্ন বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ছন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ও ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ। তিনি সরকারের কাজে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ করা অনুচিত বলে মন্তব্য করেছেন। বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) বিকেলে নিজের ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে এই মন্তব্য করেন তিনি।

আসিফ মাহমুদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, সরকারে থেকে রাজনৈতিক দলের সাথে কোনও প্রকার সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে আমরাও। উপদেষ্টাদের কেউ রাজনীতি করলে সরকার থেকে বের হয়েই করবে। একই সাথে রাজনৈতিক দলেরও সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করা অনুচিত। বিভিন্ন সরকারি/সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে তদবির/চাপ প্রয়োগ করা অনুচিত।

  • সরকারের কাজে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ করা অনুচিত
    আসিফ মাহমুদ
    উপদেষ্টা
    স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়

বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) বিকেলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে অভিযোগ করেন, ‘ছাত্র এবং অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে মাইনাস করার পরিকল্পনা ৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়েছে। ৫ আগস্ট যখন ছাত্র-জনতা রাজপথে লড়াই করছে, পুলিশের গুলি অব্যাহত রয়েছে, তখন আমাদের আপসকামী অনেক জাতীয় নেতা ক্যান্টনমেন্টে জনগণকে বাদ দিয়ে নতুন সরকার করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন (অনেকে ছাত্রদের কথাও বলেছেন সেখানে)। আমরা ৩ আগস্ট থেকেই বলে আসছি, আমরা কোনও সেনা শাসন বা জরুরি অবস্থা মেনে নেবো না। আমাদের বারবার ক্যান্টনমেন্টে যেতে বলা হলেও সেখানে যেতে অস্বীকার করি। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে আলোচনা ও বার্গেনিংয়ের মাধ্যমে ড. ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এই সমন্বয়ক বলেন, ‘জাতীয় সরকার হলে ছাত্রদের হয়তো সরকারে আসার প্রয়োজন হতো না। জাতীয় সরকার অনেক দিন স্থায়ী হবে, এই বিবেচনায় বিএনপি জাতীয় সরকারে রাজি হয়নি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরেই দেশে জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল। অথচ বিএনপি জাতীয় সরকারের কথা বলছে সামনের নির্বাচনের পরে। ছাত্ররাই এই সরকারের এবং বিদ্যমান বাস্তবতার একমাত্র ফ্যাক্টর, যেটা ওয়ান-ইলেভেন সরকার থেকে বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে।’ বিএনপি কয়েক দিন আগে ‘মাইনাস টু’র আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ নামে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রস্তাবনা করছে বলেও অভিযোগ করেন উপদেষ্টা নাহিদ। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের পরিকল্পনা গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্র-জনতা কোনোভাবেই এটা মেনে নেবে না এবং আমি মনে করি, এটা বিএনপির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র।’

প্রসঙ্গত, একদিন আগে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের কাছে বিবিসি বাংলা জানতে চায়, আপনার কি ধারণা যে, এই সরকারের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে? জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আসতে পারে। কেননা, এখানে আমরা জিনিসটা লক্ষ্য করছি যে, আপনার ছাত্ররা তারা একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করার কথা চিন্তা করছেন। সেখানে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এই সরকারে থাকে, তাহলে তো নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। ওইটা হচ্ছে, সম্ভাব্য কথা। কিন্তু যদি তারা মনে করে যে, (সরকারে) থেকেই তারা নির্বাচন করবেন, তাহলে তো রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না।’ মির্জা ফখরুলের মন্তব্যের জেরে এবার পাল্টা তীর ছুড়লেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। একই দৌড়ে দেখা গেলো হাসনাত আব্দুল্লাহকেও।

  • আওয়ামী লীগকে চাইলেও নতুন দলের উত্থান চায় না বিএনপি
    হাসনাত আবদুল্লাহ
    আহ্বায়ক
    বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একধরনের বৈপরীত্য নিয়ে এগুচ্ছে বিএনপি’র রাজনীতি। একদিকে ক্ষমতার একেবারে কাছাকাছি অবস্থান। অন্যদিকে অনিশ্চয়তা। রাজনীতিতে যদিও এটা কোনো অভিনব দৃশ্যপট নয়। ক্ষমতার মসনদে বসা কোনো সহজ বিষয় নয়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একধরনের দ্বান্দ্বিক অবস্থান তৈরি হয়েছে দলটির। তারা স্মরণ করেন, বন্ধুত্ব ক্ষণকালের কিন্তু দ্বন্দ্ব চিরদিনের। তবে শত্রুতা না এলেই হলো।’ যদিও ‘গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস।

কালের আলো/আরআই/এমকে