বেড়ে যাচ্ছে পুষ্টির ঘাটতি

প্রকাশিতঃ 10:10 am | January 25, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

দ্রব্যমূল্যের চাপে সীমিত আয়ের মানুষ এখন বাজার খরচ কাটছাঁট করছেন। কমেছে আমিষজাতীয় পণ্যের কেনাবেচা। আর তাতে পুষ্টির ঘাটতি আরও বেড়ে যাচ্ছে। কাঁচা সবজির দাম হাতের নাগালে থাকলেও চাল, ডালসহ অন্য নিত্যপণ্যে ঊর্ধ্বগতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কমছে ক্রয়ক্ষমতা। খরচ বাঁচাতে অন্য কিছু পদক্ষেপের পাশাপাশি বাধ্য হচ্ছেন খাবারের তালিকায় পরিবর্তন আনতে। আমিষ-প্রোটিনে চলছে কাটছাঁট। এতে পরিবারের সদস্য আক্রান্ত হচ্ছে রোগ-অসুখে। শিক্ষাব্যয়, রোগ-অসুখের সঙ্গে খাবারের মেন্যু পরিবর্তনেও আসছে না স্বস্তি।

বাজারে কেবল যে গরু ও খাসির মাংসের দাম বেড়েছে তা–ই নয়, ফার্মের মুরগি, ডিম, দুধ ও মাছের মতো সব ধরনের প্রোটিনজাতীয় খাবারের দাম চড়া। পরিবারের পাশাপাশি এর প্রভাব পড়েছে মেস জীবনেও। সেখানে আমিষ-প্রোটিনের উৎসই এখন প্রায় শূন্য। ভর্তা-ভাজিই যেন নিত্যসঙ্গী। এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীরে যে পরিমাণ প্রোটিন দরকার সেটি না পেলে পুষ্টিহীনতা দেখা দিতে পারে। তাদের মতে, পুষ্টিহীনতার কারণে নানান রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। এতে শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়, উৎপাদন কমে যায় কলকারখানায়। জাতীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, ৮ ধরনের প্রাণিজ আমিষে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান আছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে দেশের মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার। বাকিরা পারছে না। সাধারণভাবে শিশু, গর্ভবতী মা ও অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। এই খাবারগুলো তাঁদের নিয়মিতভাবে না পাওয়া আশঙ্কাজনক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি জরিপের তথ্য মোতাবেক- দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ৩০ দশমিক ২ শতাংশ শিশুই অপুষ্টির শিকার। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মূল্যস্ফীতির কারণে অপুষ্টিজনিত এ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। নিত্যপণ্য মূল্যের দ্রুত উত্থান-পতনের কারণে এর প্রভাব খাদ্যবাজারে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। বছরখানেক আগে ‘শিশুর অপুষ্টির মাত্রা ও প্রবণতা’ শিরোনামের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, বাংলাদেশের পাঁচ বছরের কম বয়সি ২৬ শতাংশ শিশুই পুষ্টির অভাবে খর্বকায় হয়ে পড়েছে। দেশে এমন শিশুর সংখ্যা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার। এ ছাড়া দুই বছরেরও কম বয়সি ২ কোটি ৩০ লাখ শিশুর মধ্যে খর্বাকৃতির সমস্যা ক্রমবর্ধমান। আর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি)-এর তথ্যমতে, দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অপুষ্টির শিকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা কমবেশি অব্যাহত থাকলে শিশুদের পুষ্টি সমস্যা আরও বাড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক অধ্যাপক মনে করেন-‘বাড়ন্ত বয়সের বাচ্চাদের বৃদ্ধির জন্য প্ল্যান্ট প্রোটিন (উদ্ভিজ আমিষ) পর্যাপ্ত না। বাচ্চাকে অ্যানিমেল প্রোটিন (প্রাণিজ আমিষ) খেতেই হবে। বাংলাদেশের মানুষ ভাত বেশি খায়। তাই তাদের দৈনিক প্রোটিনের চাহিদার অনেকটাই এখান থেকে পূরণ হয়। কিন্তু তারা কি মানসম্পন্ন প্রোটিন খাচ্ছে? কারণ প্রাণিজ আমিষ ও উদ্ভিজ আমিষ দুটোই প্রয়োজন। উদ্ভিজ্জ আমিষ দিয়ে প্রাণিজ প্রোটিনের অপরিহার্য মাত্রাটি পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ প্রাণিজ প্রোটিনের ক্ষেত্রে যে ২০টি অ্যামাইনো এসিড দিয়ে প্রোটিন তৈরি হচ্ছে, গ্রোথের জন্য সেটির গুরুত্ব অন্যরকম। প্রতি কেজি ওজনের জন্য দশমিক ৮ গ্রাম প্রোটিন দরকার। তার মধ্যে ৩০ শতাংশ অবশ্যই প্রাণিজ প্রোটিন থাকতে হবে।

এডুকেশন ওয়াচ-২০২৩ এর একটি গবেষণা বলছে, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে শিক্ষার্থীপিছু পরিবারের শিক্ষাব্যয় আগের বছরের তুলনায় প্রাথমিকে ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৫১ শতাংশ বেড়েছে। এই ব্যয়ের বড় কারণ কোচিং-প্রাইভেট ও নোট গাইড। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের শাখা ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের সবশেষ প্রকাশনা বলছে, বাংলাদেশের মানুষকে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের বহন করতে হয়। তালিকায় বাংলাদেশের ওপর আছে শুধু আফগানিস্তান। দেশটির নাগরিকদের নিজেদের বহন করতে হয় ৭৮ শতাংশ ব্যয়। খরচ ক্রমাগত বেড়েই চলছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের মানুষকে চিকিৎসার জন্য ৬২ শতাংশ ব্যয় বহন করতে হতো।

এসডিজি অ্যাকশন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের একটি সূত্র জানায়, দেশে ৪৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা খরচ মেটাতে কোনো না কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হন। দেশের জনগণ তাদের স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ নিজেরাই সংস্থান করতে বাধ্য হন। দরিদ্র ২০ শতাংশ পরিবার মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি সুবিধার ২০ শতাংশও ভোগ করতে পারে না। দরিদ্র জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য সরকারের বরাদ্দও অপর্যাপ্ত।

আবার নানা হিসাব-নিকাশ কষে খরচ বাঁচাতে হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে নিত্যদিনের অফিস যাওয়া হেঁটেই সারছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। কথা হয় একটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে কর্মরত এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি থাকেন বাসাবো এলাকায়। নাম-পরিচয়ে আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বেতন থেকে হোম লোনবাবদ টাকা কেটে নেওয়া হয়। এরপর যা আসে তা দিয়ে চলছে না। সন্তানের পড়ালেখা আর সংসারের খরচ নিয়ে টানাটানি। শাক-সবজিই এখন মাছ-মাংসের মতো মনে হচ্ছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। তাই হেঁটে অফিসে আসা-যাওয়া করি প্রায় সময়। হাঁটাহাঁটি করার সময় পেতাম না আগে। এখন হেঁটে অফিস করছি, ব্যায়ামও হচ্ছে।’

কালের আলো/আরআই/এমএসএএকে