আর কতোদিন মেধাবী তারুণ্যকে কোটার যন্ত্রণায় ভুগতে হবে?
প্রকাশিতঃ 2:10 am | February 18, 2018
শরিফুল হাসান:
সরকারি চাকুরিতে ৫৬ শতাংশ নিয়োগ হচ্ছে কোটার ভিত্তিতে। অার ৪৪ শতাংশ মেধায়! বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অার কোন দেশ অাছে যেখানে মেধার চেয়ে কোটার জোর এতো বেশি?
প্রচলিত এই কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে অাজ অান্দোলনে নেমেছিলেন কয়েক হাজার তরুণ। শুনলাম এই অান্দোলনকারীদের রাজাকার, অাল বদর অার খালেদা জিয়ার অনুসারী বলা হয়েছে।
যারা এমন গালি দিয়েছেন, তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে জিজ্ঞাসা করি, অাপনারা কী জেনে বুঝে অাল বদর অার খালেদা জিয়ার সমর্থনকারীদেই পাল্লা ভারি করলেন? কারণ দেশের ৯৫ ভাগেরও বেশি জনগোষ্ঠীই তো চলমান কোটা পদ্ধতির সংস্কার চায়। কেন চায় শুনবেন?
তার অাগে অাপনারা কোটধারীরা যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পতাকাধারী মনে করেন তারা একটু বলেন তো, অামাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যতো লোক অংশ নিয়েছেন তাদের কতোজন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছে? অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া অামার বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তার কোন সনদ নেই। অামার অালমগীর মামা মুক্তিযোদ্ধা। সনদ নেই। এমন শত শত উদাহরণ সারাদেশে অসংখ্য। দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়া এই যোদ্ধারা স্বেচ্ছায় কিংবা ভুল করে হলেও সনদ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
অার বাস্তবতা যদি বলেন, রাজাকার অার গুটিকয়েক লোক বাদে ৭১ এ পুরো বাংলাদেশই তো স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। গ্রামে গঞ্জে প্রচুর মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অাশ্রয় দিয়েছে। তাহলে তারা কেন কোটার সুবিধা পাবে না? তাদের কথা না হয় বাদ দিলাম এ দেশের ৩০ লাখ শহীদের কারও কী মুক্তিযোদ্ধা সনদ অাছে? কয় লাখ ধর্ষিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদ অাছে? বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কতোজন সনদ নিয়েছেন? তার মানে অাপনারা যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা চাইছেন তারা অাসলে সনদধারীরা জন্য কোটা চাইছেন তাই তো।
কোন সন্দেহ নেই, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা জাতির বীর সন্তান। তাদের মধ্যে যারা সনদধারী তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকুরি পাবেন বাংলাদেশে সেটা অামি সানন্দে মেনে নিতে রাজি। কিন্তু তাদের সন্তান অার নাতি পুতিরা কী এমন করলো যে তাদেরও কোটা দিতে হবে?
অাপনারা নাতি পুতিরা যারা এই কোটা চান তারা কী নিজেদের প্রতিবন্ধী মনে করেন? নয়তো কোটা চান কেন? অামি তো মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারী অনেককে চিনি যারা কোটায় নয় মেধায় চাকুরি পেয়েছে। অামি বিশ্বাস করি অাপনারা কোটা ছাড়া মেধাতেই চাকুরি পেতে পারেন।
অারেকটা বিষয, অাপনারা যারা কোটার সুবিধা চান বলেন তো সুযোগ সুবিধা নিতে নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধ করেনি অাপনার স্বজনরা? অামি জানি কাল যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটার সব সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন অার সনদ বা ভুয়া সনদ নেওয়ার দীর্ঘ লাইন হবে না।
অার কোটা সংস্কারের কথা বলা মানে শুধু কী মুক্তিযোদ্ধা কোটা? অামি যদি বলি ৫ শতাংশ অাদিবাসী কোটার বদলে সেটা এক বা দুই শতাংশ হওয়া উচিত? অামি যদি বলি মুক্তিযোদ্ধা কোটা এখন অার ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়? অামি যদি বলি সবমিলিয়ে ৩০ শতাংশ কোটা অার ৭০ শতাংশ মেধা থেকে নেওয়া উচিত বলেন তো অামি অযৌক্তিক দাবি করলাম?
অাপনি কী জানেন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সবার সমান সুযোগ থাকার কথা। সেখানে কোথাও কোটার কথা নেই। অার কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ হচ্ছে শুধুমাত্র একটা সরকারি ঘোষণা দিয়ে। এর কোন অাইনি বা সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। অার সে কারণেই কোটা সংস্কারের দাবিটি অামি যৌক্তিক মনে করি।
অার অাপনারা মুক্তিযোদ্ধারাই বলুন তো, ১৬ কোটি জনগনের দেশে মাত্র ২ লাখ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা কতোটা যৌক্তিক। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমন উদাহরণ আছে কি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধারা এই ধরনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে থাকেন?
অরেকটা কথা। অাপনারা যদি কোটাই চান তাহলে সেনাবাহিনীতে নিয়োগে কেন কোটার দাবি তুলেন না? সাহস নেই? অাচ্ছা বলেন তো অামাদের সেনাবাহিনীতে কর্মকর্তা নিয়োগে কেন কোটা নেই?কেন সেখানে কোটা নয় যোগ্যতাই চাবিকাঠি? কারণ তারা একটা পেশাদার বাহিনী চায়। কাজেই জনপ্রশাসনেও যদি গতি অানতে হয় মেধার দাপট বাড়াতেই হবে। এজন্যও কোটার সংস্কার দরকার।
কোটার কারণে মেধাবীরা কীভাবে বঞ্চিত হবে শুনবেন? প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু অংশ নেন সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থী (চলতি বছরের হিসাবে)। কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি না-ও পেতে পারেন। কারণ ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে। কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না। আবার কোটা থাকলে কেউ সাত হাজারতম হয়েও চাকরি পেতে পারেন।
অার সবচেয়ে বড় সংকট কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে ওই পদগুলো শুণ্য রাখতে হয়। ফলে একদিকে যেমন মেধাবীরা নিয়োগ পায় না অন্যদিকে হাজার হাজার পদ শুণ্য থাকে। বিগত কয়েকটি বিসিএসের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যাওয়ায় ২৮ থেকে ৩৫ তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে পাঁচ হাজার পদ খালি থেকে গেছে।
অবস্থাটা ভাবুন। মেধাবীরা উত্তীর্ণ হয়েও একদিকে চাকরি পাননি, আর অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কৃষি কর্মকর্তাদের মতো কারিগরি ক্যাডারের প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন।
অাপানার কী জানেন কোটার শূন্য পদগুলো পূরণ করতে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী ও মহিলাদের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পিএসসি। অথচ ওই বিসিএসেও মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি ও উপজাতির ২৯৮টিসহ মোট এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়। শেষ পর্যন্ত ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে এই পদগুলো পূরণের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ ৩২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ৯১২ জনই চাকরির সুযোগ পাননি।
শুধু কী বিসিএস? গত বছর ৯ হাজার ৬০৯ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ করা হয়। এসব পদের মধ্যে ২ হাজার ৮৮২টি পদ মুক্তিযোদ্ধার কোটাভুক্ত ছিল। কিন্তু এর জন্য প্রার্থী পাওয়া গেছে মাত্র ১০১ জন।
শুধু পিএসসি বা সরকারি চাকুরি নয়, কোটার প্রার্থী না পাওয়ায় রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার পদ শুন্য থাকছে। অথচ লাখ লাখ ছেলেমেয়ে একটা চাকুরি পাচ্ছে না।
তবে কোটার বিরোধিতাকারী কাউকে কাউকে অনেকসময় দেখেছি সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করেন। মনে রাখবেন মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কোটার সংস্কার অাপনি চাইতেই পারেন কিন্তু দয়া করে কাউকে ছোট করবেন না।
চলমান কোটা পদ্ধতির যে সংস্কার প্রয়োজন সেটা যে কোন বোধসম্পন্ন মানুষই স্বীকার করবে। এমনকি সরকারি কর্ম-কমিশনও (পিএসসি) প্রতিবছর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই কোটা সংস্কারের কথা বলে আসছে। ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটা প্রস্তাব সরকারকে দেয় পিএসসি। কিন্তু বাস্তবে কোটা সংস্কারের সব প্রস্তাবই কাগজে বন্দি হয়ে রয়েছে।
এ ছাড়া সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ (বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার) বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার ওপর ২০০৮ সালের মার্চে একটি গবেষণা করেন। ৬১ পৃষ্ঠার এই গবেষণা প্রতিবেদনে কোটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৭ সালে এক বৈঠকে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের প্রায় সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র এম এম জামান ছিলেন কোটার পক্ষে।
তবে কোটার পক্ষে সেদিন জামানের অবস্থান থাকলেও তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবস্থাটি চালু রাখার পক্ষে ছিলেন। তবে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন তিনি। ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়। তবে ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি।
চলমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে প্রতিদিন শত শত তরুণের সঙ্গে অামার কথা হয়। তারা সবাই কোটা পদ্ধতিকে মেধাবী তরুণদের জন্য অভিশাপ বলে মনে করেছেন। তারা এই কোটা পদ্ধতির সংস্কার চান। অন্যদিকে মেধানির্ভর জনপ্রশাসন গড়তেও এই কোটা পদ্ধতির সংস্কার দরকার।
তবে প্রশ্ন হলো কবে সেটি হবে? আর কতোদিন মেধাবী তারুণ্যকে এই কোটার যন্ত্রণায় ভুগতে হবে? অামি মনে করি খুব দ্রুতই কোটা সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। অার সেটা হওয়ার অাগ পর্যন্ত একটা নিয়ম করতে হবে। সেটা হলে, কোন পদে কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা দিয়ে পূরণ করতে হবে। পিএসসি কিছুটা হলেও সেই কাজ করছে। বাকিদেরও সেটা করতে হবে। অার অাজ হোক কাল হোক কোটার কাঁটা থেকে জাতিকে মুক্ত করতেই হবে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট