রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়ছে
প্রকাশিতঃ 1:49 pm | January 26, 2025
কালের আলো রিপোর্ট:
সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে- এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়ছে। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এবং এর মিত্র দল ও জোটগুলোর বেশির ভাগই প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। ছাত্র সমন্বয়করা সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। সবে শুরু হওয়া বছরটিতে সংস্কার, নির্বাচন ও ঐক্য- এই তিন বিষয় মূলত প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ঐক্য ধরে রাখাটা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জানা যায়, বিএনপি ও এর মিত্ররা নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোয় সংস্কার চায় প্রথমে। আর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে বলছে তারা। জামায়াতে ইসলামী আগের অবস্থান থেকে সরে এসে এখন প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলছে। তবে ইসলামী আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের কথা বলে আসছে। সংস্কার নাকি নির্বাচন- নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তাদের সবাই দ্রুত একটি রোডম্যাপ চাইছে।
পাশাপাশি বিএনপি’র নেতৃত্ব সচেতনভাবে নির্বাচনি ঐক্য নিয়ে সতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ‘বন্ধুবেশে’ কোনও-কোনও দল রয়েছে; তাদের ক্ষেত্রে কী করণীয় তা সময়েই স্পষ্ট হবে। পাশাপাশি যুগপতসঙ্গীদের নির্বাচনি সমঝোতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করবে বিএনপি। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী আগেই বলেছেন, নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে ২০০ আসন পেলেও তাঁরা জাতীয় সরকার গঠন করবে।
বিএনপির সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ বা এ সংক্রান্ত স্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না রাজনৈতিক দলগুলো। কোনও-কোনও বিশ্লেষক মনে করেন, গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে তিনটি দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ফেরা, না ফেরা; দ্বিতীয়ত, দলটির দুর্নীতিগ্রস্ত ও বড় লুটপাটে অভিযুক্তদের সামনে আসা এবং তৃতীয়টি হচ্ছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সচেতন অংশটি সক্রিয় হওয়া। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন পক্ষটি সামনে আসবে— তার ওপর গভীর নজর রয়েছে বিএনপিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর।
যদিও জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নিয়মিত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছেন। পাশাপাশি দলটির শীর্ষনেতাদের গণহত্যার অভিযোগে বিচারের দাবিও করছেন তারা। সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও এ নিয়ে বিএনপির প্রতি অভিযোগ এনেছেন। তারা বলছেন, তলে তলে দলটির একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে।
জানা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। এ দুটি সংগঠনের সূত্রগুলো বলছে, শিগগির নতুন দল ঘোষণা করার চেষ্টা তাদের রয়েছে। সে লক্ষ্যে দলের ঘোষণাপত্র তৈরি করাসহ অন্যান্য প্রস্তুতিও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে তরুণদের নতুন দল গঠনের উদ্যোগে আপত্তি করার সুযোগ নেই বলে বিএনপি ও অন্যান্য দল বলছে। বিএনপি’র শীর্ষ নেতা তারেক রহমানও বিষয়টি পরিস্কার করেছেন। আশার কথা হচ্ছে- ছাত্রনেতাদের নতুন রাজনৈতিক দলকে ইতোমধ্যেই তিনি স্বাগত জানিয়েছেন, সতর্কও করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দল গঠন করতে গিয়ে কেউ যদি রাষ্ট্রীয় কিংবা প্রশাসনিক সহায়তা নেন সেটি জনগণকে হতাশ করবো। এছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের আচরণ, বক্তব্য প্রতিহিংসামূলক হলে সেটি জনগণের কাছে অনাকাক্সিক্ষত।’
তবে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চাইলে সরকারের অংশ থেকে বের হয়ে যাবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘ছাত্র উপদেষ্টারা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তিনি আর সরকারে থাকতে পারবেন না। সরকারে থেকে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তারা সরকার ছেড়ে দেবেন। বাইরে ছাত্ররা যে রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে, সেখানে আমরা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করছি না। বৈষম্যবিরোধীর নতুন কমিটি হয়েছে, জাতীয় নাগরিক কমিটির আলাদা বডি আছে। তারা তাদের মতো কাজ করছে। আমরা দল গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে চাইলে সরকার ছেড়ে দেব।’
ছাত্রদের নতুন দল গঠনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী ভেতরে-ভেতরে সহযোগিতা করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি’র সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২-দলীয় জোটের কয়েক নেতা। তারা বলেন, জামায়াত নির্বাচনী জোট করে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার চিন্তা করছে। মিত্রদের পাশাপাশি বিএনপিও এ ধরনের ধারণা করছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা বাগ্যুদ্ধে জড়িয়েছেন। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরেই দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াত ছিল না। তবে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা কমে আসে। দুই দলই আন্দোলনে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জামায়াত জুলাই অভ্যুত্থানের বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। সেটিও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে।
গত মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) বরিশালে দলীয় কর্মসূচিতে গেলে চরমোনাই পীরের দরবারে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। পরে তিনি চরমোনাই পীরের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজেও অংশ নেন। চরমোনাই পীর ও জামায়াত আমিরের সাক্ষাতের পর রাজনৈতিক মহলে আগ্রহ তৈরি হয়। বিএনপির কোনও-কোনও নেতা মনে করেন, দুই দলের আমিরের মধ্যে সৌহার্দ্য বিনিময় হলেও রাজনৈতিক বা নির্বাচী কোনও জোটের বিষয় নেই। এ বিষয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার একবার বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে নির্বাচনি রোডম্যাপ প্রকাশ্যে আসলে ঐক্য সম্পর্কে বলা যাবে।
কালের আলো/আরআই/এমকে