গাজা যুদ্ধবিরতি ও মাহুত সিনড্রম

প্রকাশিতঃ 2:23 pm | January 26, 2025

লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান:

গাজায় প্রায় ষোল মাস ধংসযজ্ঞ চালিয়ে গত ২০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখ আমেরিকার ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের- অভিষেকের পূর্বে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইজরাইল যুদ্ধ বিরতি মেনে নিয়েছে। মেনে নিয়েছে এ জন্য বলছি যে, এই একই উপাদান সম্বলিত যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব ডিসেম্বর ২০২৩ সালে উপস্থাপন করা হয় তখন ইজরাইল সম্মত হয়নি। আবারও গত মে-২০২৪ থেকে কাতার, মিশর ও আমেরিকার যৌথ যুদ্ধবিরতি উদ্যোগ সফল হয়নি যদিও হামাস এ প্রস্তাবের সময় ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আসছিল। ইজরাইলের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাবে বিলম্ব অথবা না মানার কারণ হিসাবে আমি মনে করি তিনটা দিক থাকতে পারে:

ক. রাজনৈতিক:- যুদ্ধ বিরতি মেনে নিলে কট্টরপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইটামার বেন গাবির ও অর্থনৈতিক মন্ত্রী বেজালেল স্মাসট্রিকস, বেন ইয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার থেকে সরে যাবার হুমকি দিয়েছিল সেক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর কোয়ালিশান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশংকা ছিল|

খ. সামরিক:- ইজরাইল সামরিক বাহিনী হামাসকে কোনঠাসা বা পরাজয়ের মাধ্যমে আত্মসর্মপন করার বিষয়ে আশাবাদী ছিল।

গ. মনস্থাত্বিক:- হামাসের মত সামরিক বিবেচনায় দুর্বল প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ বিরতি মেনে নেয়া ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের কাছে মনস্থাত্ত্বিক ভাবে পরাজয় বরণ করে নেয়া যা ইজরাইল National Psyche বিরোধী।

এরপরও যে কারন থাকতে পারে, তা হলো, আমেরিকার পক্ষ থেকে বা বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইজরাইলের উপর তেমন কোন চাপ ছিলনা। আর এই চাপ না থাকার কারণ হলো ‘মাহুত সিনড্রম’। আমরা যদি আমেরিকাকে হাতির সাথে তুলনা করি তাহলে ইজরাইল তার মাহুত। ইহুদিবাদী স্বার্থে ইজরাইল আমেরিকাকে মাহুত হয়ে হাতি হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। ইহুদি লবি আমেরিকাতে খুবই শক্তিশালী। তারা অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, গণমাধ্যম এমনকি হলিউড নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উদাহরণ হিসাবে বাইডেন প্রশাসনে শীর্ষ দশটা পদে ইহুদিরা আসীন ছিল, যেখানে আমেরিকাতে ইহুদিদের সংখ্যা ২%, নীচে। আর প্রায় সকল ইহুদির ইজরাইলের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। ইহুদি হিসাবে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব ইজরাইল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষা করা। যার কারনে যে দেশেরই বাসিন্দা হোক না কেন প্রায় সকল ইহুদি যুবক-যুবতী ইজরাইলের বাহিনীতে ২/৩ বৎসরের জন্য চাকুরী করে থাকে।

আমেরিকার ক্ষমতায় রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট, কালো বা সাদা কিংবা মহিলা বা পুরুষ (মহিলা প্রেসিডেন্ট পার্থী হিলারী ক্লিনটন বা কামালা হ্যারিসের ইজরাইলের প্রতি আনুগত্য তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল) যারাই আসুক না কেন ইহুদিবাদী ইজরাইলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও স্বার্থ রক্ষা অত্যাবশ্যকীয়। অন্যথায় তাদের পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য।

নেতনিয়াহুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কীভাবে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হলো?

যুক্তি সংগত ধারনা হলো, ট্রাম্প চেয়েছেন তিনি ক্ষমতা গ্রহনের সময় যেন মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধ হয়। ব্যক্তি ট্রাম্প Narcissist হিসাবে পরিচিত। তিনি কারিশমা দেখাতে পছন্দ করেন এবং যুদ্ধবাজ নন (গত টার্মে প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি কোন যুদ্ধ শুরু করেননি যা বিরল)। অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন যাবার কালে High Note -এ শেষ করার জন্য তারাও চেয়েছে গাজায় যুদ্ধ বিরতি হোক।

গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে কি আছে ও তার ভবিষ্যত

যুদ্ধ বিরতি তিন পর্বে সম্পাদিত হবে।

ক) প্রথম পর্ব, ছয় সপ্তাহের যুদ্ধ বিরতি এবং সকল ইজরাইলী ও কিছু সংখ্যক প্যালেসটাইনী বন্দীদের উভয়ের কবজা থেকে মুক্তি দেয়া।

খ) স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি ও গাজা থেকে ইজরাইল বাহিনীর পশ্চাদপসরণ করা|

গ) ৩-৫ বছরের মধ্যে গাজা পুনঃগঠন করা।

গাজায় যে গণহত্যা বন্ধ হয়েছে এর জন্য মানবতাবাদী ও স্বাধীনতাকামী লক্ষ লক্ষ মানুষের মত আমিও খুশী, তবে এই চুক্তির ফলাফল প্যালেসটাইনীদের পক্ষে আখেরে যে আসবেনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই। যদিও আমি মনে প্রাণে কামনা করি যেন মানবতার জয় হয় এবং আমি ভুল প্রমানিত হই।

কেন আমি মনে করছি, এই চুক্তির ফলাফল প্যালেসটাইনীদের পড়্গে আসবেনা?

ক. প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে গাজায় ইজরাইলী জিম্মিদের পরিবারের সদস্যদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে কিন্তু গাজাতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ, শিশু, মহিলা ও বয়স্কদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। হাজারও পরিবার ধংস হয়ে গেছে। তাদের কোন পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সামান্য এই উদাহরন থেকে বোঝা যায় আমেরিকা তথা ট্রাম্প প্রশাসন কাদের পক্ষ নিয়েছে।

খ. এই চুক্তিতে যারা মধ্যস্থতাকারী তারা সকলেই প্রো-ইজরাইলী বা প্রো- আমেরিকান (কাতার ও মিশর প্রো-আমেরিকান এবং আমেরিকা প্রো-ইজরাইলী) | অর্থাৎ গাজাতে হামাস ও ইজরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনীর খেলাতে রেফারী প্রো- ইজরাইল ও দু’জন লাইনসম্যান প্রো-আমেরিকান | এখানে উলেক্ষ যে, এই চুক্তিতে মধ্যস্থতাকারী ট্রাম্পের প্রতিনিধি স্টীভ উইজকফ একজন ইহুদি। রেফারী (ট্রাম্প) ইতিমধ্যে ঘোষনা দিয়েছেন যদি যুদ্ধ বিরতি ভঙ্গ হয়ে যুদ্ধ আবারও শুরম্ন হয় তবে আমেরিকা ইজরাইলের পাশে দাড়াবো আমি আশ্চর্য্য হবো না যদি ইজরাইল তাদের বন্দীদের ফিরে পাবার পর যে কোন ছুতায় চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়।

গ. ইজরাইল অতীতে এরকম অনেক চুক্তি মানেনি এবং তার জন্য কোন খেসারত দিতে হয়নি। যেমন অস্লো চুক্তি; দ্বিরাষ্ট্রনীতি, অসংখ্য জাতিসংঘ রেজুলেশন। (২০১৫-২০২৩ পর্যন্ত জাতিসংঘ সাধারন পরিষদে ১৫৪টি রেজুলেসন ইজরাইলের বিরম্নদ্ধে নেয়া হয়েছে) তারা মানেনি। ইজরাইল আর্য্যজাতিক ক্রিমিনাল কোট বা আর্ম্মর্জাতিক কেটি অব জাস্টিসের কোন রম্নলিং এর তোয়াক্কা করে না। পক্ষান্তরে, আমেরিকা নেতানিয়াহু ও তার সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করার কারনে আর্ম্মজাতিক ক্রিমিনাল কোটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারীর কার্যক্রম শুরম্ন করেছে।

ঘ. ট্রাম্প পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে মার্কো রম্নবিওকে নিয়োগ করেছেন। তিনি একজন প্রো-ইজরাইলী এবং বর্তমান প্রোপটে তিনি বিশ্বাস করেন প্যালেসটাইনের স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার আর কোন সুযোগ নেই। বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যানথনি বিস্নংকেন ইহুদি হিসাবে ইজরাইলের জন্য যা করেছেন মার্কো রম্নবিও ইজরাইলের প্রতি আরও অনুগত প্রমান করার জন্য holier than the pope পন্থা অবলম্ব করার সম্ভাবনা

ঙ. ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ গোন্ডিতে, নিজের জামাতা ও কন্যাসহ ৮/১০ জন ইহুদিবাদী প্রভাব বিস্তারকারী জনেরা আছেন যারা ইজরাইলের পড়ো সিদ্ধাস্ত্র নিতে আমেরিকাতে যথেষ্ট প্রভাবিত করবে। যার আলামত ইতিমধ্যে শুরম্ন হয়েছে। যেমন; ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহন করার প্রথম দিনই প্যালেসটাইনের পশ্চিমতীরে ইহুদি বসতি স্থাপনে বাইডেন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছেন। অর্থাৎ আমরা এই চার বছর পশ্চিম তীরে প্যালেসটাইনীদের উৎখাত করে সেখানে নতুন নতুন ইহুদি বসতি দেখতে পাব যা মার্কো রম্নবিও ও নেতানিয়াহুর এক রাষ্ট্র নীতির সাথে (Single Israel State) সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০১৪ সালে আমি পশ্চিমতীর সফরের সময় প্রত্যক্ষ করেছি ইহুদি রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে ইহুদি সেটেলারদের দ্বারা প্যালেসটাইনীদের ঘরবাড়ী, জমি- জিরাত, ব্যবসা দখল করে নেয়। ইউরোপিয়ান অবজারভার গ্রম্নপের সাথে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি সেই অন্যায়/অবিচার পশ্চিমা মিডিয়া এ অন্যায় দেখাবে না।

এ বিষয়ে আমার চূড়ান্ত চিন্তা/ভাবনা (Final Thoughts)

এ চুক্তি মূল ইস্যুকে আমলে নিচ্ছে না যা হলো মুক্ত প্যালেসটাইন রাষ্ট্র (Free Palestine State) ফলে ৭ই অক্টোবরের মত পরিস্থিতি পুনরাবৃত্তি হওয়ার অবকাশ থেকে গেল। ইজরাইল, আমেরিকা ও কিছু পশ্চিমা দেশ সাথে নিয়ে পশ্চিমতীরে প্যালেসটাইনীদের উৎখাতসহ বসতি স্থাপন জারি রাখবে এমনকি একটা পর্যায়ে গাজার কিছু অংশে বসতি স্থাপন সহ নিরাপত্তা চৌকি মোতায়েন করতে পারে। আমরা আবার ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বারা মধ্যপ্রাচ্যে ‘ইব্রাহীম চুক্তি’ (Abraham Accord) বাস্থবায়নের উদ্যোগ দেখতে পাব যার উদ্দেশ্য হবে মধ্যপ্রাচ্যসহ আবরদেশগুলির দ্বারা ইজরাইলের স্বীকৃতি যাতে করে ইজরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সিরিয়াতে বিরাজমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ইজরাইল গোলান মালভূমিতে অতিরিক্ত বসতিস্থাপনের পাশাপাশি সিরিয়ার আরও অংশ দখলে নিয়ে নিরাপত্তা জোনের কলেবর বৃদ্ধি করবে। এরপর পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় হুতি, হিজবুলস্নাহ ও ইরানের দিকে নজর অব্যাহত রাখবে। আমরা তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মাঝে মাঝে গুপ্ত হত্যার শিকার হতে দেখবো। মধ্যপ্রাচ্যে শাম্মি আসবে ও প্যালেসটাইনীরা অধিকার ফিরে পাবে যে দিন ‘মাহুত সিনড্রমের’ অবসান হবে অথবা আমেরিকার জনগণ এ অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে দাড়াবে অথবা আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতির পরিবর্তন হবে কিংবা আমেরিকা সম্রাজের পতন হবে।

লেখক: একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং সিকিউরিটি স্টাডিজের ছাত্র।