৪২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়েও বাঁচানো গেল না রাকিবকে

প্রকাশিতঃ 3:04 pm | January 26, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

মুক্তিপণ হিসেবে দফায় দফায় ৪২ লাখ টাকা দিয়েও বাঁচানো গেল না মাদারীপুরের যুবক রাকিব মহাজনকে। উন্নত জীবনের আশায় ইতালিতে পাড়ি জমাতে গিয়ে লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে পড়েন। সেখানকার এক বন্দিশালায় টানা তিনমাস অমানবিক নির্যাতনের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

রাকিবের মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্বজনরা। তার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে পরিবার। দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।

জানা যায়, দরিদ্র পরিবারের স্বচ্ছলতার আশায় তিন বছর আগে বাড়ি ছাড়েন মাদারীপুর সদর উপজেলার পাখিরা গ্রামের নাজিম উদ্দিন মহাজনের ছেলে রাকিব মহাজন। এরপর ধরা পড়েন লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে। সেখানেই রাকিবকে বন্দি করে চালানো হয় নির্যাতন। কয়েক দফা পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিলেও মুক্তি মেলেনি রাকিবের।

স্বজনরা জানায়, স্থানীয় দালাল জাহাঙ্গীর মৃধার প্রলোভনে পড়েন রাকিব। পরে জাহাঙ্গীরের ভায়রা সোহাগ মাতুব্বরের মাধ্যমে ২৭ লাখ টাকায় ইতালি পাঠানোর চুক্তি হয়। সমুদ্রপথে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাবার সময় লিবিয়ার দালালরা বন্দিশালায় জিম্মি করে রাকিব। এরপর আদায় করে মুক্তিপণের টাকা। শেষে রাকিবকে বিক্রি করে দেয়া হয় লিবিয়ায় বসবাসরত আরেক মাদারীপুরের ঝাউদির গ্রামের দালাল মাজেদ ফলিকার কাছে। সেও একই পদ্ধতিতে পরিবার থেকে আদায় করে আরও ১৫ লাখ টাকা। এরপর রাকিবকে খাবার দেয়া বন্ধ করে দেয় দালালরা। পরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে লিবিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে রাকিবকে রেখে পালিয়ে যায় মাফিয়ারা। বুধবার (২৬ জানুয়ারি) বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে মৃত্যু হয় রাকিবের। মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা।

নাজিম উদ্দিন মহাজন বলেন, ‘এক দালালের মাধ্যমে প্রথমে চুক্তি হয়। লিবিয়ায় পৌঁছালে আমার ছেলেকে অন্য দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। ওই দালাল তাকে বন্দিশালায় রেখে নির্যাতন করে আদায় করে লাখ লাখ টাকা। রাকিবের মৃত্যুর খবর আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমার ছেলের মরদেহটি একনজর দেখতে চাই। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই।’

স্থানীয় কয়েকজন জানান, ‘এই দালালদের হাত বড় শক্তিশালী। এলাকার মানুষও দালালদের ভয়ে কিছু বলতে পারে না। তাদের কঠোর বিচার না হলে কিছুতেই এমন মৃত্যু থামবে না। ৪২ লাখ টাকা নিয়েও রাকিবের মুক্তি মিলল না। প্রায় আড়াই বছর রাকিবের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। পরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রাকিব। আমরা এলাকাবাসী এমন দালালদের কঠোর শাস্তি চাই।’

রাকিব মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে প্রথমে ২৭ লাখ টাকা নিয়েছে। তারপরও আমার সন্তান রাকিবকে ইতালি পাঠায়নি। পরে দালালদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে আরও ১৫ লাখ টাকা আদায় করে চক্রটি। দালালদের নির্যাতনে আমার ছেলে মারা গেছে, এই ঘটনার বিচার চাই।’

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা বলেন, ‘নিহত রাকিবের পরিবার থেকে লিখিত অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মাদারীপুর থেকে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাবার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর অবৈভভাবে ইতালি যাবার পথে মারা যায় মাদারীপুরের অনেকে মানুষ। জেলার বাসিন্দারা সচেতন না হলে কোনভাবেই এই মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না। এছাড়া এই দালালদের বিরুদ্ধে মামলা হলে আসামি গ্রেফতার হয়, তারপর বাদী ও আসামিপক্ষ আপোস হয়ে যায়। এ কারণেও এই প্রবণতা কমছে না।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ্ মোহাম্মদ সজীব বলেন, ‘রাকিবের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। সেক্ষেত্রে নিহতের পরিবার থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত দিতে হবে। পরে দূতাবাসের মাধ্যমে পদক্ষেপ নিবে প্রশাসন।’

কালের আলো/এএএন/কেএ