আশা জাগিয়েছে ড্যাপ সংশোধন

প্রকাশিতঃ 10:10 am | January 27, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

অধীর অপেক্ষা ছিল। একটু দেরীতে হলেও সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) সংশোধন চূড়ান্ত হয়েছে। এই সংশোধনের দৌলতে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার ভবনের উচ্চতা, আয়তন ও ইউনিট বাড়বে। গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়াদি সন্নিবেশিত হবে নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালায়। শিথিল করা হচ্ছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বিশেষ প্রকল্প অনুমোদনের শর্তও। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মাস্টারপ্ল্যানে নগরীর বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদি ও পরিবেশ প্রাধান্য পেয়েছে। রীতিমতো আশা জাগিয়েছে ড্যাপ সংশোধন প্রক্রিয়া। ড্যাপের সংশোধিত বিধিমালার কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে রাজউক।

সূত্র মতে, রাজউক থেকে মাসখানেক আগেই টেকনিক্যাল কমিটিসহ সব পক্ষের মতামত নিয়েই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ড্যাপ সংশোধন করে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই মন্ত্রালয় সব পক্ষকে নিয়ে প্রথম দফায় এই সংক্রান্ত বৈঠক করেছে। আজ সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দ্বিতীয় দফার বৈঠকের কথা রয়েছে। ড্যাপ বাস্তবায়ন মনিটরিং ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনীর সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে সরকার। তাঁরা চূড়ান্ত করলেই প্রজ্ঞাপন হবে। চলতি মাসেই ড্যাপের নতুন সংশোধন নীতিমালা অনুমোদনের সম্ভাবনা রয়েছে। মূলত ড্যাপকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে একটি পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব ও বাসযোগ্য ঢাকা মহানগরী বিনির্মাণ করতে চায় সরকার।

জানা যায়, নগর পরিকল্পনার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একরপ্রতি জনসংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০ জন থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় ৪০০ থেকে ৫০০ জন রয়েছে; ড্যাপ সংশোধোনের মাধ্যমে এই জনঘনত্ব আরও কয়েকগুণ বাড়বে। এছাড়া প্রতি বর্গকিলোমিটার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষের বসবাস করার কথা। তবে ঢাকার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। বিদ্যমান ড্যাপে ডেনসিটি জোন (জনঘনত্ব বিবেচনায় এলাকা বিভাজন) এলাকাভিত্তিক ছিল ৩৫০টির বেশি। এর মাধ্যমে পুরো রাজউক এলাকার বিদ্যমান সড়ক, উন্মুক্ত স্থান ও নাগরিক সেবার আলোকে ভবনের উচ্চতা, আয়তন ও ইউনিট নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও ডেনসিটি জোন কমিয়ে ৬৫-তে নামিয়ে এনেছে। এর ফলে ভবনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআরের মান বেশিরভাগ এলাকার দুই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। একই হারে ভবনের আয়তন ও ইউনিটও বাড়বে। এলাকাভেদে তিন থেকে চারতলা পর্যন্ত ভবনের উচ্চতাও বাড়বে।

অতীতে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় প্রশস্ত সড়ক না থাকলেও আট থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ভবন করা যেত। কিন্তু ড্যাপের নতুন নীতিমালা অনুমোদনের পর এখন সেখানে করা যাচ্ছে চার থেকে পাঁচ তলা ভবন। ড্যাপের বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী, ১২ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত সড়কের পাশে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ধরা আছে ১.৭৫ অর্থাৎ এমন প্রশস্ত সড়কের পাশে পাঁচ কাঠার প্লটে পার্কিংসহ পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ করা যাবে। ছয় থেকে আট ফুট প্রশস্ত সড়কের পাশে ফ্লোর এরিয়া রেশিও ধরা হয়েছে ১.২৫। আট থেকে ১২ ফুট প্রশস্তের সড়কের রেশিও ১.৫, ১৬ থেকে ২০ ফুট প্রশস্ত সড়কের রেশিও ২, ২০ ফুটের বেশি সড়কের রেশিও ২.৫, ৩০ ফুটের বেশি সড়কের রেশিও ৩, ৪০ থেকে ৬০ ফুট সড়কের রেশিও ৩.৫ থেকে ৩.৭৫ ধরা হয়েছে। ফলে পাঁচ কাঠার একটি জমিতে আগে আট থেকে ১০ তলার নকশা পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ তলার।

  • প্রতিটি প্লটের জন্য এসটিপি ও ওপরে সৌর বিদ্যুৎ রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক
  • বেবিচক’র কোন বাঁধা না থাকলে নির্মাণ করা যাবে সুউচ্চ ভবন
  • যতো বড় ভবন হবে ততো বড় সড়ক থাকতে হবে
  • কোনভাবেই জলাধার ও কৃষিজমিতে ভবন করার অনুমতি দেওয়া হবে না
  • মাস্টারপ্ল্যানে প্রাধান্য পেয়েছে নগরীর বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদি ও পরিবেশ
  • ভবন নির্মাণের ব্যত্যয়ের সঙ্গে জড়িত থাকলে ছাড় পাবে না কেউই

সূত্র জানায়, মেজর জেনারেল (অব:) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার রাজউক চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসীন হওয়ার পর রিহ্যাব নেতৃত্ব তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা ড্যাপ ও বিধিমালা সংশোধনের দাবি জানায়। তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করেন। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও সরকার পুরো বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। ড্যাপ সংশোধনের প্রস্তাবনার বিষয়ে জনসাধারণের মতামত গ্রহণ করে রাজউক। জনসাধারণের মতামত গ্রহণের জন্য সংশোধনী খসড়া রাজউকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এই বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য সবাইকে অনুরোধও করা হয়। শুরু থেকেই কোন বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা না দিয়ে জনস্বার্থকেই অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। রাজউকের পক্ষ থেকেও বিদ্যমান জটিলতাসমূহকে নিরসন করে সহজ করা হয়েছে।

একই সূত্র বলছে, খসড়া ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০২৪ এবং বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বিষয়ে গত বছরের বুধবার (২৩ অক্টোবর) সংশোধন বিষয়ক কমিটির সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থার কর্মকর্তাদের নিয়ে দিনব্যাপী কর্মশালা করে রাজউক। কর্মশালায় ড্যাপ সংশোধনের বিষয়ে মতামত প্রদান করেন সংশ্লিষ্টরা। রাজউকের সভাকক্ষে চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় সংশোধনের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত মতামতের সারসংক্ষেপ উপস্থাপনা করা হয়। সেই উপস্থাপনায় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০২৪ এবং বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) (২০২২-২০৩৫) কোন মূলনীতির ভিত্তিতে সংশোধন করা হয়। একই সঙ্গে সেটি সংশোধনের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। উপস্থাপনা শেষে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ড্যাপকে আরও সহজবোধ্য, বাস্তবধর্মী এবং বাস্তবায়নযোগ্য করে সংশোধন করার বিষয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মতামত তুলে ধরেন। পরে সেটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

সূত্র মতে, রাজউক আগেই জানিয়েছিল ড্যাপ সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী ভবন নির্মাণের আগেই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বা ব্যবহার সনদ নেওয়ার বিষয়টিতে। নতুন বিধিমালায় বলা আছে, ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার অনেক আগেই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হবে। রাজউকের কর্মকর্তারা প্রতিটি পর্যায়ে থাকবেন, সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন এবং স্বাক্ষর করবেন। একটি ভবন সঠিকভাবে তৈরি হয়েছে কিনা কিংবা ভবনটি ব্যবহারের জন্য নিরাপদ কিনা, মূলত সেটি নিশ্চিত করার জন্যই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এই আইনি নথি সাধারণত স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা সিটি করপোরেশন দিয়ে থাকে। এর আগে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রচলন ছিল। এতে নানা ধরনের সমস্যার মুখে পড়তো হতো। কিন্তু নতুন বিধিমালায় এই সমস্যার সমাধান করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

সূত্র মতে, ড্যাপের সংশোধিত বিধিমালায় প্রতিটি প্লটের জন্য এসটিপি বা সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং ওপরে সৌর বিদ্যুৎ রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কোন বাঁধা না থাকলে নির্মাণ করা যাবে সুউচ্চ ভবন। ভবনে অবশ্যই ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। একটি ভবন নির্মাণ করতে গেলে পর্যাপ্ত জমি ছাড়তে হবে। যতো বড় ভবন হবে ততো বড় সড়ক থাকতে হবে। স্থানীয় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সঙ্গে ভূমিকম্পের বিষয়টি সম্পর্কিত। পানির স্তর নিচে নেমে গেলে পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে। এ কারণে ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনভাবেই জলাধার ও কৃষিজমিতে ভবন করার অনুমতি দেওয়া হবে না। ভবন নির্মাণের ব্যত্যয়ের সঙ্গে জড়িত থাকলে রাজউজ কর্মকর্তা, মালিক ও আর্টিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার বা প্ল্যানার কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এছাড়া ঢাকার আশপাশের যেসব ভবন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা আগে অনুমোদন দিয়েছে সেই ভবনগুলোকেও রাজকের অধীনে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। টেকনিক্যাল কমিটি পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। ভবনগুলোতে নিরাপত্তার অভাব ও কোন রকম ব্যত্যয় থাকলে রাজউক অ্যাকশনে যাবে।

  • এবার ড্যাপ সংশোধন করা হচ্ছে সকল এলাকায় বৈষম্য নিরসনের জন্য। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা এটিকে দ্রুত কার্যকর করতে আন্তরিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন।
    মেজর জেনারেল (অব:) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার
    চেয়ারম্যান
    রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)

গত বছরের ডিসেম্বরে রিহ্যাব ফেয়ারের একটি অনুষ্ঠানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব:) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার জানান, রাজধানীর ভবনের উচ্চতা এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালার জটিলতা নিরসন করা হচ্ছে। রিহ্যাবের দাবি রাজউকের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করার। সেটি বিবেচনায় রেখে রিহ্যাবের দাবি বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এছাড়া ঢাকার চার পাশে কয়েকটা বাণিজ্যিক শহর করারও পরিকল্পনা রয়েছে।’

এ বিষয়ে কালের আলোর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ড্যাপ সংশোধনের বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মতামত নিয়েছি। তাদের দাবি এবং সার্বিক দিক বিবেচনা করে ড্যাপ সংশোধন হচ্ছে। সবার গত কয়েক মাসের পরিশ্রম ও টিম ওয়ার্কের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে। খুব দ্রুত এটি কার্যকর হবে।’ রাউজক চেয়ারম্যান বলেন, ‘এবার ড্যাপ সংশোধন করা হচ্ছে সকল এলাকায় বৈষম্য নিরসনের জন্য। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা এটিকে দ্রুত কার্যকর করতে আন্তরিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন।’

কালের আলো/এমএএএমকে