পলিথিনমুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে দেশজুড়ে তৎপর পরিবেশ মন্ত্রণালয়

প্রকাশিতঃ 10:00 pm | January 28, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

দেশের বাজারগুলো নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে সয়লাব। পলিথিনের সর্বব্যাপ্ত ব্যবহারে বিপন্ন দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। মুদি দোকান থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডিম, তরকারি, ফল, মিষ্টিসহ যে কোনো পণ্য পলিথিনের ব্যাগে ভরে দেওয়াই যেন নিয়ম। পলিথিন মাটিতে না পচার কারণে কৃষিজমির উর্বরতাও নষ্ট হয়ে কমে যাচ্ছে ফলন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল মেয়াদী বিএনপি সরকারের শাসনামলে বাজারগুলোতে পলিথিনমুক্ত করে সাফল্য দেখিয়েছিলেন পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ। এরপর বিগত পতিত সরকারের শিথিল নীতির কারণে ফের বাজারে ফিরে পলিথিন। মাইক্রোপ্লাস্টিক পৌঁছে যায় মানুষের মস্তিষ্কে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই ২০০২ সালে নিষিদ্ধ এই পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপরতা শুরু করেন। নতুন বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ রক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন। দেশের কাঁচাবাজারসহ খোলাবাজারে গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিনের তৈরি ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পলিথিন উৎপাদন বন্ধ, কাঁচাবাজার, সুপারশপেও পলিথিন নিষিদ্ধের বিষয়ে আগে থেকেই ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু নির্দেশনা কার্যকর না হওয়ায় অ্যাকশনে যায় মন্ত্রণালয়। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব চটের বা পাটের ব্যাগকে প্রমোট করা হয়।

শুধু তাই নয়, পলিথিন নিষেধাজ্ঞা কার্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পাটজাত দ্রব্যকে প্রণোদিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর পৃথক পৃথক মেলার আয়োজন করে। যেখানে সুপারশপ মালিকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। পলিথিনের পরিবর্তে কাপড়, কাগজ, পাট বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের মেলায়।

জানা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে বরাবরই জোর দিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধকরণ কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পৃক্ত করেছে। গত মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি অনুষ্ঠানে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবকের হাতে সনদপত্র তুলে দেন উপদেষ্টা। ওইদিন তিনি বলেন, ‘পলিথিনবিরোধী কার্যক্রম সফল করতে তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ অপরিহার্য। পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করে টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পলিথিনের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রেখে যেতে আমাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।’

সূত্র মতে, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে উৎপাদক ও বিক্রেতাদের কাক্সিক্ষত সাড়া না মেলায় পলিথিন বন্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়। নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ৫ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে দেশব্যাপী পরিচালিত পলিথিন বন্ধে অভিযানের মনিটরিং করছে। মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রয়োজনে মাঠ কার্যক্রম পরিদর্শন করছে। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরও একটি আলাদা কমিটি গঠন করেছে। অধিদপ্তরের কমিটি প্রতিদিন বিকাল ৫টার পর পরিচালিত অভিযানের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটিকে পাঠাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত সোমবার (২৭ জানুয়ারি) নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন উৎপাদন, বিক্রয়, সরবরাহ ও বাজারজাতের বিরুদ্ধে ভোলা, লক্ষীপুর, রংপুর, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, ফেনী এবং ঢাকার গুলশান ও ভাটারা এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১১টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। এসকল অভিযানে ১৬টি মামলার মাধ্যমে ৫৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয় এবং আনুমানিক ১ হাজার ৩০০ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করা হয়। পাশাপাশি গুলশান কাঁচাবাজার ও বারিধারা নতুন বাজারসহ বিভিন্ন দোকান মালিককে সতর্কতামূলক বার্তা প্রদান করা হয়।

নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া অবস্থানের মধ্যেই গত রোববার (২৬ জানুয়ারি) পরিবেশ অধিদপ্তর পুরান ঢাকার চকবাজারের কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালায়। ওই অভিযানে পশ্চিম ইসলামবাগের মো. কবির হোসেন ও মো. ইলিয়াছ সরদারের ভাড়া করা বাসা থেকে দুই লাখ ৬৮ হাজার টাকার ৪০ মণ পলিথিন জব্দ করা হয়। জব্দ করা পলিথিন একটি পিকআপে উঠিয়ে ফেরার পথে ১৫০ থেকে ২০০ জন লাঠি, ইট ও লোহার রড দিয়ে আভিযানিক দলের ওপর হামলা চালায়। হামলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মুহাঃ শওকাত আলী গুরুতর আহত হন। হামলাকারীরা পিকআপ থেকে ৪০ বস্তা পলিথিন ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় চকবাজার থানায় পরিবেশ অধিদপ্তর একটি মামলা দায়ের করে। পরে গত দু’দিনে পুলিশ অভিযান চালিয়ে প্রথমে মো. হুমায়ুন কবির ও মো. আরিফুল ইসলাম নামে দুজনকে এবং পরে খোকন, শাহাবুদ্দিন, মো. নাজমুল হাসান উজ্জ্বল ও মো. সুমন নামে আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে, পরিবেশ অধিদপ্তরের আহত পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মুহাঃ শওকাত আলীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) তার বাসায় যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এ সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এ সময় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পলিথিন বিরোধী অভিযানে পরিচালকের ওপর হামলাকে নিন্দনীয় বলে উল্লেখ করেন। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি জানান, ভিডিও দেখে ইতোমধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অবশিষ্ট দোষীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

পরিবেশ উপদেষ্টা আহত পরিচালক ও পরিবারের সদস্যদের তাঁর চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলেন এবং প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সহায়তার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘দেশের প্রয়োজনে কাজ করতে গিয়ে বাধা আসবেই। আমাদের নতুন উদ্যমে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। অবৈধ পলিথিন উৎপাদন ও বিপননের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে।’

কালের আলো/এমএএএমকে