জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কি?’ নম্রভাবে বললো, ‘তারেক রহমান’

প্রকাশিতঃ 9:14 pm | January 29, 2025

আফজাল এইচ খান:

গত শতাব্দীর ৭০-এর দশক। আমি তখন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিও বাংলাদেশ-এ ইংরেজি খবর পাঠক। হ্যাঁ, এখন টেলিভিশনে যাদেরকে সংবাদ উপস্থাপক-উপস্থাপিকা বলা হয়, তখন আমাদেরকে বলা হতো পাঠক-পাঠিকা। এই কাজের পাশাপাশি আরো কয়েকটি কাজ করতাম। এর একটি রেডিও বাংলাদেশ-এ দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা। আজকের দিনে যাকে বলা হয় রেডিও জকি বা আরজে, আমি ছিলাম তাই। এছাড়া রেডিও-টেলিভিশনে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার ধারাবর্ণনাও দিতাম আমি।

১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময় একদিন ওয়ার্ল্ড মিউজিক অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করছি। এখনকার রেডিও জকিদের মতই শুরুতে নিজের কথাবার্তা বলে পর পর কয়েকটা গান বাজাই। কখনো নিজের পছন্দে, কখনো শ্রোতাদের পছন্দে বাছাই হয় সেই গান। সেদিনও নিজের উপস্থাপনার কিছু অংশ সেরে টেকনিশিয়ানের হাতে দিয়ে আসি গোটা পাঁচেক গানের তালিকা, তিনি শেলফ থেকে সেসব গানের রেকর্ড নামিয়ে একের পর এক বাজাবেন। সেই গান চলার অবসরে কাচঘেরা স্টুডিও রুম থেকে বাইরে বের হয়ে আসি। উদ্দেশ্য, ছোট্ট এই সময়টায় সিগারেটে কয়েকটা টান দেওয়া।

রুম থেকে বাইরে বের হয়েই দেখি মোটামুটি লম্বা করিডোর ধরে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে ১১/১২ বছরের এক বালক। গায়ে হাফ হাতা সাদা শার্ট, ফুল প্যান্ট। দূরে দাঁড়িয়ে আছে সুঠামদেহী মধ্যবয়সী দুই পুরুষ। একজন তীক্ষ্ণ নজর রাখছে সেই বালক ও আমার ওপর, অন্যজন বার বার মাথা ঘুরিয়ে নজর রাখছে চারদিকে।

বালকটি আমার সামনে এসে বেশ বিনয়ের সঙ্গে নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কি ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ অনুষ্ঠানের প্রেজেন্টার আফজাল এইচ খান?’ সম্ভবত আমার কাছে এগিয়ে আসার আগেই দূর থেকে রেডিওর কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী আমাকে দেখিয়ে সেই পরিচয় বলে দিয়েছিলো। কাছে এসে আমার নাম উচ্চারণে তার কোনো জড়তা ছিলো না, হয়তো টেলিভিশনে ইংরেজি খবর দেখার সুবাদে আমার চেহারার সঙ্গে নাম তার কাছে পরিচিত ছিলো। শুধু জানতো না একই ব্যক্তি ওয়ার্ল্ড মিউজিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কিনা।

টেলিভিশনের খবর পাঠক কিনা সেটি জানতে চাওয়ার বদলে ওয়ার্ল্ড মিউজিক অনুষ্ঠানের প্রেজেন্টার কিনা জানতে চাওয়ায় আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। কারণ ১১/১২ বছরের একটি বালক ওয়ার্ল্ড মিউজিক অনুষ্ঠান শোনে, এটাই আমাকে কৌতূহলী করে তুললো।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কি?’ নম্রভাবে বললো, ‘তারেক রহমান।’ আমার পরের প্রশ্ন, ‘রেডিও স্টেশন দেখতে এসেছো?’ ওর জবাব, ‘না। নবীন কণ্ঠ অনুষ্ঠানে আমাদের স্কুল অংশ নেবে, এজন্য এসেছি।’ সেসময় ‘নবীন কণ্ঠ’ ছিলো স্কুলের বাচ্চাদের একটি অনুষ্ঠান, ওয়ার্ল্ড মিউজিকের পরে যার রেকর্ডিং হবে। এবার জানতে চাইলাম ওর স্কুলের নাম, জবাব দিলো ‘সেন্ট জোসেফ হাই স্কুল।’ বললাম ‘আরে, আমিও তো সেই স্কুলেরই ছাত্র! সেখান থেকেই আমি সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেছি।’

এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাসা কোথায়?’ জবাব এলো, ‘ক্যান্টনমেন্টে।’ একথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই আমার পরের প্রশ্ন ছিলো, ‘তোমার বাবা সেনাবাহিনীতে আছেন?’ বালকটি আগের মতোই অত্যন্ত নম্রভাবে জবাব দিলো, ‘জ্বি।’ জানতে চাইলাম, ‘তোমার বাবার নাম কী?’ বললো, ‘জিয়াউর রহমান।’

তারেক রহমান নামের বালকটি আমার প্রতিটি প্রশ্নেরই জবাব দিচ্ছিলো ছোট্ট করে। তার বাবার নামের আগে সেনাবাহিনীর পদবীও বলেনি। তাই জানতে চাইলাম, ‘উনার র‌্যাঙ্ক কী?’ এবার জবাব, ‘মেজর জেনারেল।’

তখন সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল পদবীর কর্মকর্তার সংখ্যা খুবই কম, আঙ্গুলে গোনা যায়। আমরা যারা তখন সমাজের ওপরতলার মানুষজনের খোঁজখবর রাখতাম, তারা জানতাম সেসময় সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নামই জিয়াউর রহমান, তিনি একাধারে সেনাপ্রধান ও দেশের প্রেসিডেন্ট।

তাই বালকটির বাবার পদবী শুনে কিছুটা চমকে গেলাম। ইংরেজিতে প্রশ্ন করলাম, ‘ডু ইউ মিন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান?’ আবারো সে ছোট্ট করে নম্রভাবে, কিছুটা লাজুক ভঙ্গিতে জবাব দিলো, ‘ইয়েস।’ এবার বুঝতে পারলাম দূরে দাঁড়ানো সুঠামদেহী দুই পুরুষের এখানে থাকার রহস্য। তারা প্রেসিডেন্ট-পুত্রের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীরই সদস্য।

‘তুমি ওয়ার্ল্ড মিউজিক অনুষ্ঠান শোনো? ইংরেজি গান শোনো?’ আমার এবারের সেই প্রশ্নের জবাবে ‘হ্যাঁ’ বলার পরই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজকের অনুষ্ঠানের জন্য তোমার কোন পছন্দের গান আছে?’

‘হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া’ গানটির কথা বললো তারেক রহমান। আমি ওকে দাঁড়াতে বলে স্টুডিও রুমে ঢুকে টেকনিশিয়ানকে আর দুটি গানের পরই ‘হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া’ গানটি বাজানোর জন্য লংপ্লে রেকর্ড নামিয়ে রাখার নির্দেশনা দিলাম। যথাসময়ে বাজলো গানটি। ১৯৭৭ সালেরই ফেব্রুয়ারিতে রিলিজ হয়েছে ৭০ দশকের বিখ্যাত রক ব্যান্ড ‘ঈগলস’-এর এই গান। রিলিজ হওয়ার পরই বিপুল জনপ্রিয়তা এই গানটি এখনো বিখ্যাত ক্লাসিক গানের মর্যাদা পেয়ে আসছে।

পরে স্টুডিও রুম থেকে বের হয়ে এসে বালক তারেক রহমানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর ইউ হ্যাপি?’ সলজ্জ হাসিতে জবাব দিলো, ‘জ্বি।’

সেদিনের সেই বালক তারেক রহমানকে দেখেছিলাম নম্র, ভদ্র, মৃদুভাষী। বাবার পরিচয়ের কোনো অহমিকা-দাম্ভিকতা নেই। বরং বাবার প্রেসিডেন্ট পরিচয় দেওয়ার সময়ও তার মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য কাজ করেনি। দীর্ঘ ৪৮ বছর পর আজও যখন তার কথা শুনি তখনও আমি সেই নম্র-ভদ্র তারেক রহমানকেই খুঁজে পাই।

স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পুত্র, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান— এসব পরিচয়ও তার নম্রতা-ভদ্রতা কেড়ে নিতে পারেনি। কোনো অহমিকাবোধ স্পর্শ করতে পারেনি তারেক রহমানকে।

লেখক: সাবেক সংসদ সদস্য ও সাংবাদিক।