বাংলাদেশ নিয়ে আইসিজির প্রতিবেদন, যা জানা গেল

প্রকাশিতঃ 3:47 pm | January 31, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও এর সদস্যদেশগুলো কোথায় শান্তির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে, তা চিহ্নিত করে প্রতিবছর ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) একটি পর্যবেক্ষণ তালিকা প্রকাশ করে। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরও সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশ ছাড়াও এতে ইউক্রেন, সিরিয়া, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, ইরানসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাম রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) প্রকাশিত আইসিজির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

এতে ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশবিষয়ক জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা (হানিমুন) এখন পুরোপুরি শেষ। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দর-কষাকষি করায় এবং নির্বাচনী সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় এই বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অন্তর্বর্তী সরকার চাপে রয়েছে, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে তারা পেয়েছে।

থমাস কিয়ান বলেন, অর্থনীতিকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চলমান প্রচেষ্টার সুফল বাংলাদেশের জনগণের বাস্তবে পেতে আরও সময় লাগবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে এখনও টানাপোড়েন রয়েছে আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

তিনি আরও বলেন, এরপরও আগামী বছর বাংলাদেশের সামনে দেশটির জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক করার একটি বিরল সুযোগ রয়েছে। এ লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলো কয়েক শ’ প্রস্তাব সম্বলিত প্রতিবেদন জমা দিতে শুরু করেছে।

ক্রাইসিস গ্রুপের এই কনসালট্যান্ট বলেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার প্রক্রিয়ার সমর্থনে এবং অন্তর্বর্তী সরকার যাতে বাংলাদেশকে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয় তা নিশ্চিতে আলাপ-আলোচনা, কারিগরি ও আর্থিকভাবে বিদেশি অংশীদারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গণ-অভ্যুত্থানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ও তার সমর্থকদের প্রত্যাশা, এই ভোট কেবল গণতন্ত্রই পুনরুদ্ধার করবে না, বরং ১৫ বছরের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী ও দমনমূলক শাসনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা করবে।

শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের যে ব্যাপক সমর্থন ছিল তা এখন কমে গেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউনূস সরকারের জন্য বাস্তব ফলাফল দেখানোর চাপ বেড়েছে। তার সরকার শুধু অন্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে ফাটল কমাতে সংগ্রাম করছে না, বরং দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনাতেও জনসমালোচনার মুখে পড়ছে।

এতে বলা হয়, আগামী বছর বিরোধী দল, ছাত্রনেতা, ইসলামপন্থী দলগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রা নির্বাচনী সুবিধা পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করায় চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনও সংকটমুক্ত হয়নি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতি সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সরকারের সংস্কারের কিছু পদক্ষেপ ইতিবাচক ফল দেখাতে পারে, যেমন ব্যাংকিং খাতের উন্নয়ন ও দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা থাকলে অর্থনীতি আরও বিপদের মধ্যে পড়তে পারে।

আইসিজির মতে, বাংলাদেশের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক। ভারতীয় সীমান্তে উত্তেজনা এবং মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা এখনও সমাধান হয়নি। এসব সমস্যা মোকাবিলায় ইইউ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা প্রয়োজন।

প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে জানানো হয়, বাংলাদেশের সামনে নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এগুলো কাজে লাগাতে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য ও আন্তর্জাতিক সমর্থন। ইইউ ও তার সদস্য দেশগুলোর সহায়তায় বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠন আরও ত্বরান্বিত করতে পারে।

ইউনূস সরকারের ভাবমূর্তি কীভাবে উজ্জ্বল হবে, সে বিষয়ও তুলে ধরেছে ক্রাইসিস গ্রুপ।

প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চপর্যায়ের সফর ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজে সমর্থনের ওপর জোর দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে ড. ইউনূস সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চাওয়া শক্তিগুলো দুর্বল হয়। পাশাপাশি নতুন অংশীদারি প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতামূলক চুক্তি করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে।

একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিকে কারিগরি এবং আর্থিকভাবে সমর্থন দেওয়া দরকার। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা, শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন ও মানবাধিকার রক্ষাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে পারে ইইউ। নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণে একটি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানো উচিত এ জোটের।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সমর্থন আদায় করে জাতীয় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে অবদান রাখতে পারে ইউরোপ। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার- আরও আকর্ষণীয় বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে। তৈরি পোশাক উৎপাদন খাতের বাইরে এনে দেশের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করার প্রচেষ্টায় সমর্থন, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সম্পদ পুনরুদ্ধারে সহায়তা এবং ২০২৯ সালের পরও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার বিস্তৃত করতে ঢাকার সঙ্গে সমঝোতা চালিয়ে যাওয়া দরকার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা কমাতে কাজ করা প্রয়োজন। উভয়ের মধ্যে অনাস্থা কাটিয়ে সম্পর্ককে ভালো অবস্থানে নিতে ইইউর উচিত হবে দুই পক্ষের ওপরই প্রভাব খাটানো।

একইসঙ্গে রোহিঙ্গা ও তাদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অর্থায়ন অব্যাহত রাখা দরকার বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন আয়োজনে ঢাকার চেষ্টাকে সহায়তা প্রদান এবং সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগে অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে।

ক্রাইসিস গ্রুপের এই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাব এনাম খান গণমাধ্যমকে বলেন, হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয়েছে, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং এটি কঠিন রাজনৈতিক সত্য। সরকারও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে যাওয়ার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, সরকার সংস্কারের কথা বলছে, কিন্তু এই সংস্কারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্ভুক্তি বা সংহতির জায়গাটা ফাঁকা রয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও সর্বোচ্চ দুর্বল অবস্থায় আছে, যা তাদেরকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। তাই ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশ যত দ্রুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ফিরবে, স্থিতিশীলতার পক্ষে সেটা ততোই ভালো হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, সংস্কারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফেরত যাওয়া। আমি মনে করি, আইসিজির প্রতিবেদনটি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।

এর আগে, গত আগস্টে ক্রাইসিস গ্রুপ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় প্রবেশ করছে।

কালের আলো/এসএকে