ট্রাম্পের শুল্কবাজিতে বিশ্ব মূল্যস্ফীতিতে আরেক টোকা
প্রকাশিতঃ 6:24 pm | February 04, 2025
মোস্তফা কামাল:
হুমকি নয়; কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ বাস্তব করে দিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ করে শুল্ক আরোপ হয়েছে। আর চীনা পণ্যে বর্তমান হারের চেয়ে বাড়তি শুল্ক ১০ শতাংশ। ট্রাম্প আগে থেকেই হুমকির সাথে গর্বও করছিলেন। বলেছিলেন, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এই শুল্ক আরোপ মার্কিন অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হবে। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের খবরকে স্বাগত জানিয়েছেন রিপাবলিকানরা। বিপরীতে ডেমোক্র্যাটরা পণ্যমূল্যের ওপর এ পদক্ষেপের প্রভাব নিয়ে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও শুল্ক আরোপের ঘটনা ‘অবশ্যই ঘটবে’ বলে বার্তা দিয়েছেন তিনি। তবে কবে থেকে তা করা হবে, সে বিষয়ে কিছু বলেননি ট্রাম্প। বাস্তবটা বোঝা যাবে আরো ক’দিন পর। আর মার্কিনিদের জন্য যা আশীর্বাদ, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য তা কতোটা অভিশাপ সেই বিশ্লেষণও চলছে। তিনটি দেশের ওপর ট্রাম্পের এ শুল্ক আরোপ এরইমধ্যে বিশ্ব জুড়ে মূল্যস্ফীতিতে নতুন থাবা বসিয়ে দিয়েছে। দিন শেষে মার্কিনীদেরও এ থেকে রক্ষা মিলবে না।
দ্বিতীয় দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদে ট্রাম্পের অভিষেক হয় গত ২০ জানুয়ারি। সেদিনই তিনি ১ ফেব্রুয়ারি কানাডা ও মেক্সিকো থেকে পণ্য আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার হুমকি দেন। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, এই দুই দেশ বিপুলসংখ্যক লোককে (অবৈধ অভিবাসী) যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার সুযোগ দিচ্ছে। দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানাইল নামের ভয়ংকর মাদক ঢুকতে বলেও অভিযোগ তার।
চীনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ। তাই এসব দেশকে তাদেরকে একটা শিক্ষা দেয়া জরুরি ভাবেন তিনি। ভাবনা দৃষ্টে সিদ্ধান্ত। ট্রাম্পের শুল্কারোপ নিয়ে হোয়াইট হাউসের নথিপত্রে বলা হয়েছে, ‘সংকট না কমা পর্যন্ত’ শুল্ক বহাল থাকবে। কিন্তু শুল্কারোপের স্থগিতাদেশ পেতে দেশ তিনটিকে কী করতে হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করেনি হোয়াইট হাউস। ট্রাম্প শুল্ক আরোপ ধরনের কিছু করলে ওইসব দেশও বসে থাকবে না-এ ধারণা ছিল আগে থেকেই। তাও বাস্তবে মিলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছে কানাডা, মেক্সিকো ও চীন। সুপার পাওয়ারদের এ শুল্কবাজি-পাল্টা অ্যাকশন বিশ্বে বাণিজ্যযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আঘাতের পাশাপাশি নতুন মেরুকরণের আলামতও স্পষ্ট। বিশ্বে নতুন এক বাণিজ্যযুদ্ধ এবং বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে মন্দাভাব ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা নতুন রূপ পাওয়ার অপেক্ষা।
এর আগে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের রেশে বিশ্ব অর্থনীতিতে লাগা আগুনের তেজ এখনো দমেনি। তারওপর এখন শুল্কবাজির পাল্টাপাল্টি সেই আগুরে ঘি ফেললো। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদারদের অন্যতম চীন, কানাডা ও মেক্সিকো। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি পণ্যের ৪০ শতাংশ গেছে এ তিন দেশ থেকে। তিনটি দেশ থেকেই পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপের ফলে এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও পণ্যের দাম চড়ার লক্ষণ ঘুরছে।
এ আভাস ট্রাম্প নিজেও দিয়েছেন। কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করায় ‘স্বল্প মেয়াদে’ মার্কিন নাগরিকেরাও যন্ত্রণার শিকার হতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশটি কানাডা থেকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারের অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। এটি ছিল কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা পণ্যের প্রায় এক–চতুর্থাংশ।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের সব আমদানি পণ্যের প্রায় অর্ধেকই ট্রাম্পের শুল্কারোপের আওতায় পড়বে। এ নিয়ে সংকট কাটাতে দেশটিকে তার নিজস্ব পণ্যের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি করতে হবে। স্বল্প মেয়াদে এটা বাস্তবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফরেন ট্রেড কাউন্সিলের (এনএফটিসি) সভাপতি জ্যাক কোলভিন বলেছেন, ট্রাম্পের পদক্ষেপে অ্যাভোকাডো থেকে শুরু করে অটোমোবাইল—সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। উত্তেজনা এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর প্রতি দ্রুত একটা সমাধানের পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ রপ্তানি খাতে এগিয়ে গিয়েছে বাণিজ্য উদারীকরণের সুযোগ নিয়ে। এখন বড় বাজারগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমদানিতে শুল্ক আরোপ শুরু করে, সংরক্ষণবাদিতা শুরু হবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোরই অসুবিধা হবে। কারণ সময়টা বড় সঙ্গীন। কার লাভে কার ক্ষতি, কোনো সুযোগ নিতে গিয়ে কার চক্ষুশূল হয়ে পরে পস্তাতে হবে- সেই ভাবনা এড়ানো যায় না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের এ সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কানাডা ও মেক্সিকো। জাতিসংঘের কমোডিটি ট্রেড স্ট্যাটিস্টিকস ডেটাবেসের তথ্য অনুযায়ী, কানাডার বার্ষিক রপ্তানির ৭৮ শতাংশ ও মেক্সিকোর ৮০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানি মাত্র ১৪ শতাংশ কানাডা থেকে ও ১৫ শতাংশ আসে মেক্সিকো থেকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিকল্প বাজার খোঁজা সহজ হলেও কানাডা ও মেক্সিকোর জন্য তা কঠিন হবে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পাল্টা ব্যবস্থায় বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কী দশা হতে পারে-এ বিষয়ক অনেক জিজ্ঞাসা রয়েছে। স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ ক্রয়াদেশ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুফল পেতে পারে বলে কারো কারো প্রাথমিক ধারণা। কম ও মধ্যম দামের পোশাকের ক্রয়াদেশের একটি অংশ চীন থেকে সরে বাংলাদেশে আসতে পারে বলে উচ্চাশা তাদের। বাংলাদেশের পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাত বাড়তি ক্রয়াদেশ বা অর্ডার পেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা চীন থেকে কারখানা সরিয়ে এখন অন্য দেশে নিতে আগ্রহী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে গন্তব্যের একটি হতে পারে বাংলাদেশ।
বিশ্ববাজার সম্পর্কে ওয়াকেবহালরা জানেন- জাপান, কোরিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিকারক চীনা কোম্পানিগুলোও এখন কারখানা অন্য দেশে সরিয়ে নিতে বাধ্য হতে পারে। এর বিপরীতে শঙ্কাও আছে। বাংলাদেশ রপ্তানি খাতে এগিয়ে গিয়েছে বাণিজ্য উদারীকরণের সুযোগ নিয়ে। এখন বড় বাজারগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমদানিতে শুল্ক আরোপ শুরু করে, সংরক্ষণবাদিতা শুরু হবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোরই অসুবিধা হবে। কারণ সময়টা বড় সঙ্গীন। কার লাভে কার ক্ষতি, কোনো সুযোগ নিতে গিয়ে কার চক্ষুশূল হয়ে পরে পস্তাতে হবে- সেই ভাবনা এড়ানো যায় না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।