দেশের স্বার্থেই জাতীয় ঐক্যকে কেন সুসংহত করতে হবে?

প্রকাশিতঃ 10:20 pm | February 04, 2025

রাজনৈতিক ভাষ্যকার, কালের আলো:

বহু মানুষের রক্তের তাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে নতুন বাংলাদেশ। ফ্যাসিবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়েছে ভয়ের সংস্কৃতি। শহীদদের চেতনাকে ধরে রেখে জুলাই অভ্যুত্থান জুগিয়ে চলেছে অন্তহীন প্রেরণা। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসকের পতনের মধ্যে দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ভেতর যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটি শুধুমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এর জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজনের পাশাপাশি সংস্কারের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও বহুত্ববাদী দেশ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। হাজার প্রাণের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে ঐক্য।

দেশের ইতিহাসের অনন্য এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্ররা; সর্বস্তরের মানুষ ও রাজনৈতিক দল এতে যুক্ত হয়েছেন। রক্তের সারি আর দীর্ঘ না করতে এগিয়ে আসে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীও। সবার সম্মিলিত ঐক্যেই সফল হয় গণঅভ্যুত্থান। রক্ত বন্যার হাত থেকে মুক্ত হয় দেশ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত করতে মাত্র মাস দুয়েক আগে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে সব মত-পথ ভুলে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। অবশ্যই এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। চলমান প্রতিটি বড় সঙ্কট মোকাবিলায় এই ঐক্য বজায় রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও বলেছেন, ‘২০২৫ সালে আমরা একটা দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে যেতে চাই। সে জন্য সবাইকে একসঙ্গে চলতে হবে।’ গত ৫ আগস্টের আগে-পরে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকা দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তিনি বারবার ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী। অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন করে সেনাপ্রধান তাৎপর্যপূর্ণ উচ্চারণে আগেই বলেছেন- ‘অস্থির সময়ের পর দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। আমি নিশ্চিত যে আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার জন্য আন্তরিকভাবে নিজের সব রকমের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বরাবরই ‘গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা’ অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরেছেন। তাঁর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরুর পর থেকেই বিগত সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘুরে দাঁড় করানোর বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। এমন পটভূমিতে বর্তমান সরকার জনআকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রথমে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করে। এরপর আরও কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়। ইতোমধ্যেই নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশন তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে।

ওইদিনও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘৫ আগস্টে যেটা হয়েছে, সেটা সমগ্র জাতির আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই হয়েছে। সে আকাঙ্ক্ষাকে যেন ধরে রাখতে পারি। কারণ, এটার সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব নেই। আমরা একমত ছিলাম, এখনও একমত আছি। নানারকম খুঁটিনাটি বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আবার আমরা ঐক্যে ফিরে যেতে চাই। আমাদের পুরো প্রচেষ্টাটাই হল জাতির ঐক্যকে এক জায়গায় নিয়ে আসা।’ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট জাতীয় ঐক্যের এই উদ্যোগ কেবলমাত্র রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় নেতাদের একত্র করার প্রচেষ্টা নয়; এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক পুনর্জাগরণের পরিকল্পনা। যা বিভক্ত বাংলাদেশকে একক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার যুগান্তকারী ও বিচক্ষণ এই উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে নসাৎ করার সব ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়। আইন উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুল মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংকালে জানিয়েছেন, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ছয় সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। একই সঙ্গে সুপারিশ পেশ করা হবে।

ড. ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের ডান-বাম মিলিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহ একসঙ্গে বসে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে একমত পোষণ করেছে। অবশ্যই এটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সাধারণত, আমাদের দেশে রাজনীতি বলতেই অনৈক্য, বিদ্বেষ ও দোষারোপের সংস্কৃতি। সেখানে বিভিন্ন মত-পথের এতগুলো দল একসঙ্গে বসাকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে না দেখে উপায় নেই। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.আসিফ নজরুল সেদিন বলেছিলেন ‘সভার মূল সুর ছিল, আমাদের মধ্যে মত, পথ ও আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে, অবস্থানে ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু দেশ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই এক। সবার ওপরে দেশ। এই রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে এই বার্তা জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।’

দেশের শক্তিশালী ভবিষ্যতের আশা জাগানোর সময়টিতেই আবার হঠাৎ দেখা গেলো, নির্বাচন, সংস্কার, গণহত্যার বিচার নিয়ে বিরোধ-বিভক্তি তৈরি হয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগে স্বত:স্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে দেশ ফ্যাসিবাদী শাসন বা স্বৈরাচার থেকে সাময়িকভাবে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু জাতিগতভাবে দেশ এখনও পুরোপুরি সঙ্কটমুক্ত হতে পারেনি। বিভিন্ন সমস্যা কিংবা আরও জটিল সঙ্কটে দেশ নিমজ্জিত হতে চলেছে। জনগণের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন দেশীয় অপশক্তি এবং বিদেশি আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের বহুমুখী চাপের মধ্যে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। জাতিগতভাবে অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে ঠেকেছে। এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকে অতি দ্রুত একটি নির্বাচন দিয়ে সরে যেতে বলার মূল সুরই হচ্ছে দেশটিকে একটি নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া। এখন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের অভাব পুনরায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। সঙ্কটময় এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দেশের সব দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দলের সম্মিলিতভাবে একটি জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সবার লক্ষ্য রাখতে হবে-ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সফল গণঅভ্যুত্থানের অর্জন যেন কোন অবস্থাতেই বিনষ্ট না হয়। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই দেশি-বিদেশি সব অপশক্তি বা স্বার্থান্বেষী মহলকে রুখে দিতে হবে।

অতীতে বহুবার জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া হলেও সেটি রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে পরাজিত হয়েছে। মতবিরোধের রাজনীতি তীব্রতর করার সুযোগ নেই। জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলনকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। জাতীয় ঐক্যের প্রকৃত রূপায়ণের জন্য কয়েকটি মৌলিক পদক্ষেপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের আস্থা-বিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে জাতীয় ঐক্যের অংশ হতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সঙ্কট মোকাবিলার জন্য একটি শক্তিশালী রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। চলমান সব সঙ্কট নিরসনে ঐতিহাসিক জাতীয় ঐক্যের সুযোগকে আক্ষরিক অর্থেই সঙ্কট সমাধানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অনন্য উদাহরণ তৈরি করতে হবে। জাতীয় ঐক্যে যেন কোন অবস্থাতেই সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। বিভেদ-বিভক্তির রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করা বাংলাদেশকে তাঁর কাঙ্খিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এদেশের মানুষ আর কোন অবস্থাতেই পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায় না। তাঁরা পরিবর্তনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে একটা জাতীয় ঐকমত্য অর্জন করতে হবে। কোন রকম বড় বিভক্তি বা বিভাজন যেন তৈরি না হয় সেদিকে সবার সচেতন থাকা জরুরি কর্তব্য। আরও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে এগিয়ে যাওয়াটাই হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য একটি পথ।

কালের আলো/আরআই/এমকে