সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের দুর্গে যৌথ বাহিনীর হানায় স্বস্তি

প্রকাশিতঃ 10:59 pm | February 09, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট।’ ‘ডেভিল হান্ট’ বা শয়তান শিকারের এই অভিযানের মাধ্যমে মূলত দেশবিরোধী চক্র, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের বোঝানো হয়েছে। এটি মূলত পুলিশি অ্যাকশন। সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও বিজিবি সব রকমের সহায়তা দিচ্ছে। শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাত থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে জনমনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের দুর্গে হানা দেওয়া হচ্ছে। গত দু’দিন অপারেশন পরিচালনা করে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ প্রসঙ্গে রোববার (০৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর খামারবাড়িতে মৃত্তিকা ইনস্টিটিউটের একটি নবনির্মিত ভবন উদ্বোধনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, এ ক্ষেত্রে যারা আইন অমান্য করে, দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসী, তারাই গ্রেপ্তার হবে।’

একই দিনে রোববার (০৯ ফেব্রুয়ারি) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নিয়ে এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যৌথভাবে সকলে মিলে অপারেশন ডেভিল হান্ট করা হচ্ছে। একটি ফোকাসডওয়েতে কিছু কাজ করবে। যেসব জায়গা থেকে দেশকে পরিস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটাকে আমরা নিউট্রালাইজ করবো। সেজন্য আইনানুগ পন্থায় যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেগুলো নেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ। সেজন্য সব বাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়েছে, ব্রিফিং করা হয়েছে এবং কাজও চলমান রয়েছে। আমরা আজও করেছি এবং এটা চলতে থাকবে।’

রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাহিনীর সমন্বয়ে একটি সেন্ট্রাল কম্যান্ড সেন্টার সন্ধ্যা থেকে কাজ শুরু করেছে। এর ফলে খুব দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’

  • সারা দেশে ব্যাপাক সাড়া ফেলেছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’
  • দু’দিনে গ্রেপ্তার ১ হাজার ৩০৮ জন
  • আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সেই লক্ষ্যে জোর
  • গোয়েন্দা তথ্য মোতাবেক দমন করা হবে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকেও 

সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সন্ত্রাসীরা দেশকে অকার্যকর ও অস্থিতিশীল করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করতে তাঁরা দেশে কয়েকটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত করেছে। তাই দেশের সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শুরু করা হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর যৌথভাবে পরিচালিত এই অপারেশনের প্রাথমিকভাবে বেশ কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণে সারা দেশে একযোগে অপারেশন পরিচালনা করা হচ্ছে।

কারা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে এবং এই সন্ত্রাসীরা কীভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে এই বিষয়গুলোও সনাক্ত করা হয়েছে। এরপরই দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যেন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সেই লক্ষ্যে জোর দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম গোয়েন্দারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। গোয়েন্দা তথ্য মোতাবেক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে দমন করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ এর মাধ্যমে।

  • যারা আইন অমান্য করে, দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসী, তারাই গ্রেপ্তার হবে
    লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
    উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

জানা যায়, ডেভিল অর্থ হচ্ছে শয়তান আর হান্ট অর্থ শিকার। ডেভিল হান্ট, যার ইংরেজি শাব্দিক অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় শয়তান শিকার করা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত ডেভিল হান্ট বলতে, দেশবিরোধী চক্র, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় আনতে বুঝানো হয়েছে। অপারেশন ডেভিল হান্ট একটি বিশেষ অভিযান। যা ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে একযোগে শুরু হয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী হামলা করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। এই হামলায় নেতৃত্ব দেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। হামলার ফলে বেশ কয়েকজন হতাহত হন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে অপারেশন ডেভিল হান্ট নামক বিশেষ অভিযান শুরু হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সন্ত্রাস নির্মূলের এই বিশেষ অপারেশনে গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সারা দেশে একযোগে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করবে পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি। ড.ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এই অভিযানকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে আগেই বলেছেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

  • যৌথভাবে সকলে মিলে অপারেশন ডেভিল হান্ট করা হচ্ছে
    নাসিমুল গনি
    সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

জানা যায়, এই অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা আইনের আওতায় এসেছে। উদ্ধার করা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র। তাদের দুর্গ তছনছ করে দেওয়া হচ্ছে। এই অভিযানকে দীর্ঘমেয়াদি করতে চায় সরকার। সন্ত্রাসবাদের মূল উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অপারেশন ডেভিল হান্ট ঘোষণার পর পরই সবগুলো বাহিনী একসঙ্গে সমন্বিতভাবে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। সব গোয়েন্দা তথ্য একসঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট টার্গেটকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

আমাদের গাজীপুর প্রতিবেদক জানিয়েছেন, দেশজুড়ে চলমান অপারেশন ডেভিল হান্টের অংশ হিসেবে গাজীপুর জেলার ৫টি থানায় ৪০ জন ও মহানগরের ৮টি থানায় ২৫ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আটক করা হয়েছে। রাতভর অভিযান চালিয়ে গাজীপুর জেলা ও মহানগর পুলিশ তাদের আটক করে। রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে সাড়ে ৯টায় গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক বলেন, জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় অভিযান চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত (দুপুর ১টা) ৪০ জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা বিভিন্নভাবে ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন।’ এদিকে, গাজীপুর মহানগরের ৮টি থানায় মোট ২৫ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. জাহিদুল হক।

  • খুব দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা উন্নতি হবে বলে আশা করছি
    শফিকুল আলম
    প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব

আমাদের চট্টগ্রাম প্রতিবেদক জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় নোয়াখালীর হাতিয়ায় অভিযান পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও পুলিশের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী। শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে অপারেশন ডেভিল হান্টের অংশ হিসেবে পরিচালিত এই অভিযানে ৫ জনকে আটক করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। আটকরা হলেন- চর ঈশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আব্দুল মাজেদ পলাশ, আব্দুল জাহের পিন্টু, সিরাজুল ইসলাম রাফসান এবং আবুল কালাম বিটু। জানা যায়, আটকদের বিরুদ্ধে হাতিয়ায় ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আটকদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র পরে হাতিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়। ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ এর আওতায় নৌবাহিনীর দায়িত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিয়মিত টহল ও বিশেষ অভিযান চলমান রয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় জানান, অপারেশন ডেভিল হান্টে শনিবার (০৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে রোববার (০৯ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের সব মেট্রোপলিটন পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ২৭৪ জনকে। অন্যদিকে সারাদেশের রেঞ্জ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১ হাজার ৩৪ জনকে।

কালের আলো/এমএএএমকে