বিএনপি ও জামায়াতের নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু
প্রকাশিতঃ 11:23 am | February 12, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
অবশেষে দুয়ারে কড়া নাড়তে শুরু করেছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ডিসেম্বরকেই নির্বাচনের ডেটলাইন হিসেবে ধরে নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাও ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এমনটি চান না। জাপানের এনএইচকে টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৬ ডিসেম্বর গণতন্ত্র দিবসেই নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ মাঠ থেকে লাপাত্তা থাকায় এক সময়কার মিত্র বিএনপি ও জামায়াত একে অপরকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করেই নির্বাচনী মাঠ গুছাতে শুরু করেছে। বিএনপি দলীয় প্রার্থী ঘোষণা না করলেও জামায়াত ৩০০ সংসদীয় আসনেই দলীয় প্রার্থী ঘোষণার কার্যক্রম শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, ৬ ডিসেম্বর নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখের তাৎপর্য হলো ১৯৯০ সালের এই দিনে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ৩৪ বছর পর আরেকটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। এবার বিদায় নিয়েছে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। যদিও এরই মধ্যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপসহ কয়েক দফা দাবিতে ১২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে সমাবেশ করবে বিএনপি। বিএনপির নেতারা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো, নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং ফ্যাসিবাদীদের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও ‘নির্বাচনের রোডম্যাপের’ দাবিই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতোই ঘনিয়ে আসছে ততই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও তিক্ততা বাড়ছে। বিশেষ করে প্রধান দু’দল বিএনপি ও জামায়াত একে অপরের প্রতি নানা ইস্যুতে আক্রমণের তির ছুড়ে দিচ্ছেন। জামায়াতের এক নেতা বলেন, একদল দখলদারকে সরিয়ে জনগণ আরেকদল দখলদারকে ক্ষমতায় বসাতে চায় না। বিএনপির আরেক নেতার পাল্টা অভিযোগ হলো, প্রশাসন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সবখানে জামায়াতের লোক বসানো হয়েছে। এমনকি স্বাধীনতার সময় জামায়াতের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি’র কোন কোন নেতা। অন্যদিকে, বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মধ্যেও আওয়ামী লীগ ইস্যুতে বাদানুবাদ চরমে। বিএনপি যখন ছাত্রদের দলকে কিংস পার্টি আখ্যা দিয়ে সমালোচনামুখর, তখন ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ বিএনপিকে দেশের প্রথম কিংস পার্টি বলে অভিহিত করছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সর্বত্রই এখন নির্বাচনী আলাপ-আলোচনা জমে ওঠেছে। প্রধান উপদেষ্টা আগেই বলেছিলেন, নির্বাচনের ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছে। এই ট্রেন আর থামবে না। মূলত ওই সময় থেকেই দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিএনপি’র সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটতে শুরু করে। সংস্কার নিয়ে কোন কোন দল মুখে ফেনা তুললেও একই সঙ্গে তাঁরা মাঠ গুছানোর কাজও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। অবশ্য নির্বাচন যতো বিলম্বে হবে ততোই তাঁরা সাংগঠনিকভাবে আরও শক্ত-পোক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। বিপরীতে যারা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চান তাঁরা অন্যরা সংগঠিত হওয়ার আগে নিজেদের সংগঠন গুছিয়ে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় ভোটের মাঠে বাড়তি সুযোগ নিতে চান। ভারী করতে চান নিজেদের জয়ের পাল্লা।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে সংস্কারকে প্রাধান্য দিলেও ভোটের মাঠে তাদের প্রস্তুতি অন্যসব দলের চেয়ে বেশি। ইতোমধ্যেই দেশের ২১ জেলায় ১০০টি আসনে স্থানীয়ভাবে ‘সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীর’ নাম ঘোষণা করেছে দলটি। এর মধ্যে গাজীপুরে চারটি, মাদারীপুরে একটি, মেহেরপুরে দুইটি, ঝালকাঠিতে দুইটি, সিরাজগঞ্জে পাঁচটি, নওগাঁয় পাঁচটি, রাজশাহীতে পাঁচটি, খুলনায় ছয়টি, টাঙ্গাইলে আটটি, নেত্রকোনার পাঁচটি, ফরিদপুরের চারটি, কিশোরগঞ্জে পাঁচটি, ময়মনসিংহের ১১টির মধ্যে ১০টি, মৌলভীবাজারে চারটি, দিনাজপুরে ছয়টি, শেরপুরে তিনটি, কিশোরগঞ্জে ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটি, পঞ্চগড়ে দুইটি, পটুয়াখালীতে চারটি, সুনামগঞ্জে পাঁচটি ও পিরোজপুরে তিনটি সংসদীয় আসনে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী।
একই সূত্র বলছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে বাকি ২০০টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করবে জামায়াত। দলীয়ভাবে ভোটের প্রচার-প্রচারণা চালাতে প্রার্থীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও ৫ আগস্টের পর দেশজুড়ে কর্মী সম্মেলন, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি দেশব্যাপী দলীয় ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করতে এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা চষে বেড়াচ্ছেন এই সফরগুলোতে তিনি কর্মীসভা ও অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। পাশাপাশি ভোটের মাঠে বিএনপিকে পরাস্ত করতে বৃহত্তর জোট করারও প্রচেষ্টা নিয়েছে তাঁরা। ইসলামিক দলগুলোর একটি বাক্স পাঠানোর মন্ত্রে উজ্জীবিত দলটি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করে চলেছেন। গত ২১ জানুয়ারি বরিশালের চরমোনাইয়ে গিয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে দেখা করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির। দীর্ঘদিন ধরে আদর্শিক বিরোধ থাকলেও দুই নেতা আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের কথা বলেন। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের এ সাক্ষাৎ রাজনীতিতে আলোচনা তৈরি করে। আভাস দিয়েছে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের।
বিএনপি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের পতনের পর বিএনপি রাজধানীতে বিশাল বড় শোডাউন করে। এই কর্মসূচিতে ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য রাখেন দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর দৃশ্যত বড় কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না থাকলেও নতুন করে সারা দেশে সমাবেশের উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। আজ বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) থেকে এই সমাবেশ শুরু হচ্ছে। এই সমাবেশের মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীরা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের মাঠেও নিজেদের ‘বিজয়ী’ বার্তা দিতে চাইবে দলটি।
সূত্র মতে, দলটি এখনও কোন প্রার্থী ঘোষণা না করলেও দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাঁরা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ ও ২০১৮ সালের দলীয় প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে চায়। এক্ষেত্রে তরুণ প্রার্থীদের বিষয়টিও তাঁরা সুবিবেচনা করবেন। পাশাপাশি নির্বাচনের আগে মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি বা সমঝোতাও হতে পারে। অন্যান্য ইসলামী দলগুলোকেও কাছে টানার চেষ্টা করছে তাঁরা। এরই ধারাবাহিকতায় চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে গত ২৭ জানুয়ারি বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠকে শরিয়াহ্সহ দশটি বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে বিএনপিতে মাথাচাড়া দিতে পারে দলীয় কোন্দল। প্রতিটি আসনে দলটির একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। একজনের নাম ঘোষণা করা হলে অন্যজন সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় নেতা–কর্মীরা ভাগ হয়ে যাবেন এবং প্রতিপক্ষ এর সুযোগ নিতে পারেন। এদিক থেকে জামায়াতের এমন কোন আশঙ্কা নেই। তবে বিএনপি মনে করেন, দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে কারও যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিটি আসনে বিএনপি’র একক প্রার্থীই মাঠে থাকবেন।
কালের আলো/আরআই/এমকে