বাড়ছে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা

প্রকাশিতঃ 9:38 am | February 18, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী ও মগবাজার লেভেলক্রসিংয়ের দুই পাশ। মানুষ আড্ডার পাশাপাশি ব্যস্ত নানান কাজে। কেউ কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে যেতে যেতে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন, আশপাশে কোনো খেয়ালই নেই। দু-চারজন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা রেললাইনের ওপর বসে চা, পান-সিগারেট বিক্রি করছেন। লাইন দিয়ে ট্রেন একেবারে কাছাকাছি আসার পর কয়েকজনকে দৌড়ে রেললাইন পার হতেও দেখা যায়। ক্রসিংয়ে সিগন্যাল থাকার পরেও ফাঁকফোকর দিয়ে মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল ও পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। এই চিত্রটি নিত্যদিনের।

ফলে রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু। রেললাইন ধরে অসতর্কভাবে হাঁটা, কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইনের পাশ দিয়ে যাতায়াত, তাড়াহুড়া করে রেলক্রসিং পার হওয়া, ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ এবং চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তোলাসহ বিভিন্ন কারণে বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনা। এছাড়া চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা তো আছেই। ট্রেন দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ মামলাই দায়ের করা হয় অপমৃত্যু হিসেবে। সেসবের সঠিক কোনো তদন্তও হয় না।

রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় মোট মামলা হয় ১ হাজার ৫৪টি। মোট মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ৬৪ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৮২৬ এবং নারী ২৩৮ জন। কানে ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় ১৮ জনের। ট্রেনলাইনের ওপর বসে গল্প ও চলাচলের কারণে মৃত্যু হয় ৫০২ জনের। অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টার সময় মৃত্যু হয় ৩৮৭ জনের। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু ২৩ এবং অপমৃত্যু হয় (মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানা) ১৩৪ জনের।

২০২৪ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় মোট মামলা হয় ৯৯৮টি। মোট মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১০১৭ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৭৯৪ এবং নারী ২২৩ জন। কানে ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। ট্রেন লাইনের ওপর বসে গল্প ও চলাচলের কারণে মৃত্যু হয় ৫০৪ জনের। অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টার সময় মৃত্যু হয় ২৭২ জনের। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় ২৩ জনের এবং অপমৃত্যু হয় (মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানা) ১৪২ জনের।

রেল পুলিশের তথ্য বলছে, ঢাকা জোনের রেলওয়ে থানার অধীনে পাঁচটি ফাঁড়ি এলাকা থেকে গত চার বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে ১ হাজার ৮০১ জনের মৃত্যু হয়। এই ফাঁড়ি এলাকাগুলো হলো- টাঙ্গাইল, টঙ্গী, জয়দেবপুর, এয়ারপোর্ট ও নারায়ণগঞ্জ। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইন দিয়ে বা পাশ দিয়ে চলার সময়।

যদিও রেলওয়ে সদর দপ্তর জানায়, রেল এখনো ১৮৬১ সালের ব্রিটিশ শাসনামলের পুরোনো আইনে চলছে। রেলের প্রচলিত আইনে রেললাইন ধরে হাঁটা অবৈধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু লাইন নয়, লাইনের দুই পাশে (১০ ফুট করে) ১৪৪ ধারা জারি থাকে সব সময়। বাংলাদেশ রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, এই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে তাকে আইনের ১০১ ধারায় গ্রেফতার করা যায়। এমনকি এই সীমানার ভেতরে গবাদি পশু চরলে আটক করে তা বিক্রি করে সেই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধানও রয়েছে। কিন্তু এ আইন প্রতিনিয়তই ভঙ্গ করছেন পথচারীরা। তাই প্রতিনিয়তই ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে বিমানবন্দর-টঙ্গী পর্যন্ত রেললাইন যেন সড়কপথ। এপথ ধরে দিন-রাত শত শত লোক চলাচল করে। ঢাকা রেলওয়ে রেঞ্জেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয়। রেল থেকে হাজারও সচেতনতার বার্তা-ব্যানার ফেস্টুন লাগালেও সাধারণ মানুষ সচেতন হচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু এবং পূবাইল রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ঢাকা রেঞ্জের মধ্যে। এ পথেই ট্রেনে কাটা পড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত মাইকিং, ব্যানার, ফেস্টুন বিতরণ করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।

রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘রেলে দুর্ঘটনা কমাতে জনগণকে সবার আগে সতর্ক হতে হবে। কানে ইয়ারফোন, রেললাইনে বসে গল্প কিংবা রেললাইনের ওপর বাজার বসানো ঠিক নয়। ট্রেনের ছাদে একদমই ওঠা উচিত নয়। সাধারণ রাস্তাঘাটে আমরা যেভাবে চলাচল করি ঠিক সেভাবেই রেললাইনে চলাচল করতে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।’

কালের আলো/আরআই/এমএইচ