মাতৃভাষা ও ইসলাম
প্রকাশিতঃ 12:57 pm | February 21, 2025

মাহমুদ আহমদ:
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষাকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। ভাব প্রকাশক উক্তি বা সংকেতই হলো ভাষা। ভাষা হচ্ছে মানুষের মনোভাব, অনুভূতি প্রকাশের ধ্বনি নির্ভর মাধ্যম।
একটি শিশু জন্মের পর ধীরে ধীরে যে ভাষায় প্রথম কথা বলে, মনের ভাব প্রকাশ করে এবং যে ভাষাজাত সাংস্কৃতিক আবহের মধ্য দিয়ে সে বড় হয়ে ওঠে তাই মাতৃভাষা। যেমন বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, মাতৃভাষা বাংলা আমাদের জন্য আল্লাহর সেরা দান। ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা বাংলা আল্লাহতায়ালার দেয়া একটি নেয়ামত। প্রত্যেক নবি রাসুলকে আল্লাহ স্বজাতির মাতৃভাষায় প্রেরণ করেছেন। মাতৃদুগ্ধের মতই অকৃত্রিম ও মধুর আমাদের এই বাংলা ভাষা।
আমাদের ভাষা হচ্ছে বাংলা, কেউ যদি ভাবেন যে, বাংলাতে আল্লাহপাকের কাছে চাইলে তিনি কি তা শুনবেন? এর উত্তরে বলা যায় অবশ্যই আল্লাহপাক শুনবেন। কেননা, তিনি বলেছেন সকল ভাষাই তার সৃষ্ট এবং সব ভাষাতেই নবি-রসুল পাঠিয়েছেন। তাই কোনো ভাষাই আল্লাহপাকের কাছে মর্যাদার দিক থেকে কম নয়। আর এজন্য সবাই নিজ নিজ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের স্বীয় মাতৃভাষার মর্যাদা যেমন অপরিসীম তেমনি আল্লাহতায়ালার কাছে কোন ভাষাই ছোট নয়। তিনি সকল ভাষা জানেন, বুঝেন। যে যেভাবেই তাকে ডাকে না কেন তিনি বুঝেন, উত্তর দেন, তার সাথে কথা বলেন। সকল জাতিকে হেদায়াতের জন্য যেমন আল্লাহপাকের পয়গম্বর এসেছেন, তেমনি সকল জাতির স্ব-স্ব ভাষাতেই আল্লাহতায়ালার ওহি-ইলহাম নাজিল হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাব অথবা কিতাববিহীন প্রত্যাদিষ্টকে ওহি দ্বারা পাঠিয়েছেন। একেক জাতির জন্য একেক ভাষা সৃষ্টি করা এটা আমাদের ওপর আল্লাহতায়ালার বিশেষ কৃপা। আর না হয় মানুষ ভাষার মর্যাদা বুঝত না। মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার সাথে তার উন্নতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
মানুষের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের ধ্বনিকে ভাষা বলে। ভাষা আল্লাহ প্রদত্ত, এর সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। পৃথিবীতে বহু ভাষার প্রচলন ও মানব জাতির ভাষার ভিন্নতা আল্লাহ্ তা’লার অপার কুদরতের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আমরা আমাদের মায়ের কাছ থেকে জন্মসূত্রে যে ভাষা লাভ করেছি সেটাই আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। পৃথিবীর যে কোনো ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার আকর্ষণ বেশি, মাতৃভাষার মর্যাদা অতুলনীয় অনুপম। যে কারো কাছে মাতৃভাষাই শ্রেষ্ঠ এবং মাতৃভাষা চির অহংকার ও গৌরবের। লাল সবুজের বাংলাদেশে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।
বিশ্বখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহর মতে, পৃথিবীতে ২৭৯৬টি ভাষা প্রচলিত আছে। তবে ভাষার প্রকৃত পরিসংখ্যান আজও নির্ণীত হয় নি। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের সংরাগ চিরকালীন। বর্ণিল পৃথিবীকে আরো স্বাপ্নিক ও আলোকিত করতে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ যে কোনো ভাষার চেয়ে বোধ করি বেশি।
দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ ও প্রাণোৎসর্গের ঘটনা জানা থাকলেও কোনো জাতি তার মাতৃভাষার জন্য জীবনকে বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা নিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই। জাগতিক উৎকর্ষ ও নানাবিধ ব্যক্তি মোহের প্রতি কোনোরূপ ভ্রূক্ষেপ না করে বাঙালি জাতি মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্বকে অনুধাবন করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছিলো।
সেদিন ঢাকার পিচঢালা পথকে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করেছিল শহিদি চেতনায় উজ্জীবিত সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের মত নাম না জানা আরো অনেক ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলন করে নিজের প্রাণকে বিলিয়ে দিয়ে তারা মাতৃভাষা বাংলা ভাষার নাম বিশ্ব-ইতিহাসে রক্তে লিখে গেলেন। রক্তের বন্যায় সেদিন ভাষার বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছিল বাংলাদেশের ভাষা সৈনিকগণ। এ বিজয় আত্মত্যাগের, এ বিজয় গৌরবের। ভাষার লড়াইয়ে তাদের আত্মোৎসর্গ আজ বিশ্ববাসীর কাছে মর্যাদায় আসীন।
অপরিসীম গুরুত্বের সাথে মাতৃভাষাকে স্মরণ করে ইসলাম। মাতৃভাষা শিক্ষা ও বিকাশে ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। আল্লাহতায়ালা নবি-রসুলদের কাছে যুগে যুগে যে-সব আসমানি কিতাব প্রেরণ করেছেন, তা তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের ইরশাদ করেন: ‘আমি প্রত্যেক রসুলকে তার জাতির লোকদের মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি যাতে করে সে স্পষ্টভাবে তাদের বুঝিয়ে দিতে পারে’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত: ৪) যেমন হজরত দাউদ (আ.) এর কাছে যাবুর কিতাব তার মাতৃভাষা ইউনানি বা (আরামাইক) ভাষায় নাজিল করা হয়েছিল, হজরত মুসা (আ.)-এর কাছে তাওরাত ইবরানি বা হিব্রু ভাষায় নাজিল করা হয়েছি। এটাও ছিল তার মাতৃভাষা। আর সর্বশেষে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছে তার মাতৃভাষা আরবি ভাষায় পবিত্র আল কুরআন নাজিল করা হয়। এসব আসমানি কিতাব যদি মাতৃভাষায় নাজিল না করতেন তবে এগুলো নাজিলের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো।
কেননা, এসব আসমানি কিতাব নাজিলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পুণ্য হাসিলের জন্যে এর মর্ম অনুধাবন করা। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে-এর আলোকে জীবনব্যবস্থা কায়েম করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘আর যদি আমি কুরআন অনারবদের ভাষায় নাজিল করতাম তবে অবশ্যই বলতো এর আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয় নি কেনো? এ কেমন কথা, অনারবি কিতাব এবং আরবিভাষী রাসুল। আপনি বলুন: এ কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও ব্যাধির প্রতিকারস্বরূপ। কিন্তু যারা ইমান আনে না তাদের কাছে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন তাদের জন্য অন্ধত্বস্বরূপ’ (সুরা হা মীম-সাজদা, আয়াত: ৪৪)। আল্লাহপাক অন্য একটি আয়াতে ইরশাদ করেন: ‘আমি তো কুরআন আরবিতে নাজিল করেছি এ জন্য যে, তোমরা তা বুঝবে’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ২)।
মনের আকাঙ্ক্ষা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে হলেও মাতৃভাষা ব্যতীত সম্ভব হয় না। মনের আকুতি প্রকাশ করে বিনতিপূর্বক প্রার্থনায় মন ও আত্মার মাঝে এক স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি হয়। বান্দার আর্তি আল্লাহর কাছে কবুল হওয়া না হওয়া তা একান্তই তার। কিন্তু মাতৃভাষায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পেরে সাময়িক জাগতিক শান্তির ছোঁয়া অবশ্যই আমরা লাভ করি। বঙ্গবাণী কবিতায় আবদুল হাকিম তাই যথার্থই বলেছেন: ‘যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ, সেই বাক্য বুঝে প্রভু আগে নিরঞ্জন’।
অনুরূপ স্বদেশী ভাষা কবিতায় রামনিধিগুপ্ত বলেছেন: নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা? মাতৃভাষা মূলত মহান আল্লাহর দেয়া অপূর্ব নিয়ামতের অংশ। এই অপার নিয়ামতকে সার্থক করতে হলে মাতৃভাষাকে আমাদের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণায় লেখক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের লেখালেখি ও জ্ঞান-গবেষণায় মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক, ইসলামি সাহিত্য ও কোরআন-হাদিস বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে মাতৃভাষার ব্যাপক প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের ভাষা হচ্ছে বাংলা, কেউ যদি ভাবেন যে, বাংলাতে আল্লাহপাকের কাছে চাইলে তিনি কি তা শুনবেন? এর উত্তরে বলা যায় অবশ্যই আল্লাহপাক শুনবেন। কেননা, তিনি বলেছেন সকল ভাষাই তার সৃষ্ট এবং সব ভাষাতেই নবি-রসুল পাঠিয়েছেন। তাই কোনো ভাষাই আল্লাহপাকের কাছে মর্যাদার দিক থেকে কম নয়। আর এজন্য সবাই নিজ নিজ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব না দিই তাহলে আল্লাহপাকের দরবারেও আমাদের কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে না। কেননা, বাংলা ভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এই ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সকল ধর্মাবলম্বীদের রয়েছে অবদান। হজরত নবি করিম (সা.) তার মাতৃভাষা আরবি এত সুন্দর ও স্বচ্ছভাবে উচ্চারণ করতেন যে, মানুষ অবাক হয়ে যেত। আর তা ছোট বড় কারো বুঝতে কষ্ট হতো না।
আমাদের সবার দায়িত্ব, আমাদের লেখায়, কথায়, চলনে-বলনে মাতৃভাষাকে আরও বেশি করে বিশুদ্ধভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা, আমাদের ভাষাকে এমন সুন্দর ও মাধুর্যের সাথে ত্রুটিহীন ভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে কেউ এর কোনো ত্রুটি খুঁজে না পায়। ভাষার এ মাসে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সেই সব বীর শহিদ ও বীর সৈনিকদের যারা এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং লড়েছেন। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।