ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ নিশ্চিতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানো অপরিহার্য
প্রকাশিতঃ 5:19 pm | February 22, 2025

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:
দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে বেসরকারিখাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পর্যালোচনা শীর্ষক সেমিনারে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ এমন আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহের হার ডাবল ডিজিটে উন্নীতকরণ, আর্থিক খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা আনয়ন, ঋণের সুদহার হ্রাস, স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণে নীতি সহায়তার ধারাবাহিকতা, অবকাঠামো খাতে সমন্বিত উন্নয়ন, মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভ্যাট হ্রাস এবং শিল্পখাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সহায়ক জ্বালানি মূল্য নীতিমালা প্রণয়ন একান্ত অপরিহার্য।
তাসকীন আহমেদ বলেন, উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহের হার ডাবল ডিজিটে উন্নীতকরণ, মন্দ ঋণ কমাতে নজরদারি বাড়ানো, আর্থিক খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা আনয়ন এবং ঋণের সুদ হার হ্রাস একান্ত অপরিহার্য। এছাড়াও স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণে নীতি সহায়তার ধারাবাহিকতা, অবকাঠামো খাতের সমন্বিত উন্নয়ন এবং বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে আফ্রিকার বাজারে মনোনিবেশের উপর তিনি জোরারোপ করেন।
এসএমইখাতের উন্নয়নকল্পে ঋণ প্রাপ্তিতে বিদ্যমান নীতিমালার সহজিকরণ, স্বল্পসুদে অর্থায়নের লক্ষ্যে বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থার প্রবর্তন ও ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থার সম্প্রসারণ অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেন তাসকীন আহমেদ।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) মো. আব্দুর রহিম খান বলেন, আমাদের ৫০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে মাত্র ৪০ বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আহরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। অটোমেশন ও ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
হালকা প্রকৌশল শিল্পকে গেমচেঞ্জার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখাতের উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সহায়তার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গাজীপুরে একটি টেকনোলোজি সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাজস্ব আহরণ বাড়ানো এবং রপ্তানি-নির্ভর বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা না গেলে বিনিয়োগ ব্যবধান হ্রাস পাবে না।
এছাড়াও অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ ইউনুস এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা) ড. সায়েরা ইউনুস অংশগ্রহণ করেন।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে বিলম্ব ও অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর কারণে বিগত দিনগুলোতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিলক্ষিত হয়েছে, যদিও ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়ার কারণে ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিনি জানান, রিজার্ভ সংকটের কারণে কাঁচামালের আমদানি ও মেশিনারিজ আমদানিতে বিধি-নিষেধের ফলে আমাদের সাপ্লাই চেইনে স্বল্পতা দেখা দেয়, যার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এবং চলতি বছরের মধ্যে রিজার্ভ ২৫-২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলে শিল্পখাতে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি স্বল্পতা কেটে যাবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার সক্ষমতা, কার্যকর উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং আগামী অর্থবছরে গতানুগতিক বাজেট প্রণয়ন করা হলে বিদ্যমান সংকট সমাধান করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেশি হলে এবং সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়লে বেসরকারিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হবে না। তিনি উল্লেখ করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাজেট, মুদ্রানীতি ও বাজার ব্যবস্থার সমন্বয় একান্ত জরুরি। রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে বিদ্যমান ভ্যাট ব্যবস্থার অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি অভিমত দেন।
বিআইডিএসর গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্পখাতে আমাদের কমপ্লায়েন্স বাড়ানোর পাশাপাশি গবেষণার ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারিখাতের মধ্যকার সমন্বয়ও বাড়াতে হবে। এছাড়াও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের উপর জোরারোপ করা উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমাদের ওষুধ এবং চামড়াখাতের উপর আরো অধিক হারে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা) ড. সায়েরা ইউনুস বলেন, বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতার কারণে আমাদের পণ্য আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে এবং সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা নীতি হার সমন্বয়ের মাধ্যমে সেটা মোকাবেলার চেষ্টা করেছে, তবে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে পণ্য আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হ্রাস পায়নি।
অনুষ্ঠানের মুক্ত আলোচনায় ইআরডি’র অতিরিক্ত সচিব এএইচএম জাহাঙ্গীর বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত, পরিকল্পনা কমিশনের সচিবের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট খাতের সমন্বয়ের মাধ্যমে এরইমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে পজিশন পেপার তৈরির পর সরকার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্বান্ত গ্রহণ করবে। তবে এলডিসি উত্তরণ আমাদের ওপর কি ধরনের প্রভাব পড়বে তা নির্ধারণ করে সরকারি-বেসরকারিখাতের সমন্বিত উদ্যোগ ও সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
কালের আলো/এসএকে