ছাত্রদলের বিরুদ্ধে শিবিরের অভিযোগের পাহাড়
প্রকাশিতঃ 7:29 pm | February 23, 2025

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক, কালের আলো:
রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম।
সংবাদ সম্মেলনে দেশে সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দায়ে প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ, জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তি এবং ইসলাম বিদ্বেষের দায়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির সদস্য রাখাল রাহার গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানায় সংগঠনটি।
লিখিত বক্তব্যে ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পাসে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও সহাবস্থান নিশ্চিত করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা সবার দায়িত্ব। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ছাত্রশিবিরসহ অন্য ছাত্রসংগঠনকে অন্যায়ভাবে দমনের চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, নিজেরা সন্ত্রাসী কায়দায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে তার দায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, যার প্রবক্তা ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ।
তিনি বলেন, সম্প্রতি কুয়েট, এমসি কলেজ ও তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় যে হামলার ঘটনা হয়েছে তা একটি ছাত্রসংগঠনের নব্য ফ্যাসিবাদ হয়ে ওঠার ধারাবাহিকতারই অংশ বলে আমরা মনে করছি। কুয়েটে সাধারণ ছাত্রদের ওপর ছাত্রদল যুবদলের বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে। যেখানে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী মারাত্মক আহত হয়। কিন্তু ছাত্রদল তাদের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায় ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব শিবিরের ওপর দায় দিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেন, যার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা স্পষ্ট হয়ে যায়।
কুয়েটের ঘটনায় শিবির জড়িত না তা প্রমাণিত উল্লেখ করে শিবির সভাপতি বলেন, একদিকে ছাত্রশিবিরের ওপর দায় চাপিয়ে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করতে চেষ্টা করে, অন্যদিকে যুবদল তাদের চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে বহিষ্কার করার মাধ্যমে নিজের সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয়ে যায়। এ ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সিলেটের এমসি কলেজে আনযুমানে তালমীযে ইসলামিয়ার কর্মী মিজানুর রহমান রিয়াদ সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনায় দুইজন (জাহিদুল ইসলাম হৃদয় ও রিয়াদ) আহত হওয়ার দায় ছাত্রশিবিরের ওপর প্রদান করে। পরে কলেজ অধ্যক্ষের বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ পেলে ছাত্রশিবির যে সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়, তা প্রমাণিত হয়।
ছাত্রদলের মধ্যে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে উল্লেখ করে জাহিদুল ইসলাম বলেন, স্বৈরাচারী, গণহত্যাকারী শেখ হাসিনামুক্ত বাংলাদেশেও ফ্যাসিবাদের টুলসগুলো কিছু ছাত্রসংগঠন ঘোষণা দিয়ে গ্রহণ করেছে। আপনারা দেখেছেন তারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ‘শিবির কোবানো/কোপানো জায়েজ আগেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে’ এমন বীভৎস ঘোষণা দিচ্ছে। আমরা নোয়াখালীতে এমন একজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমরা আশা করব সরকার তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। শুধু তাই নয়, কুয়েটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততার মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করে। খুলনার শিববাড়ীতে তাদের মিছিল থেকে ‘একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ এই স্লোগান দেওয়া হয়। এমন ভয়ংকর, হিংস্র স্লোগান আমরা ছাত্রলীগের মুখে শুনতাম। কিন্তু ছাত্রদলের মধ্যে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
সারা দেশে ছাত্রদলের চাঁদাবাজির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারা দেশে শত শত জায়গায় চাঁদাবাজি, দখলদারি দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে কোনো পরিবর্তন হয়েছে। অপরাধীদের হাত বদল হয়েছে ঠিকই কিন্তু অপরাধ আগের মতোই চলছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি যশোরে চাঁচড়ায় চাঁদা না দেওয়ায় সম্রাট নামের এক মাছ ব্যবসায়ীর চোখ উপড়ে ফেলে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা। গতকাল (শনিবার) গাজীপুরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে চাঁদা আদায় করার ঘটনা আপনারা দেখেছেন। প্রতিদিন এমন অসংখ্য ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে।
তা’মীরুল মিল্লাত সভাপতির ওপর ছাত্রদলের হামলার কথা উল্লেখ করে শিবির সভাপতি বলেন, কুয়েটে শিক্ষার্থীদের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই গত ২০ ফেব্রুয়ারি টঙ্গীতে তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও ছাত্রশিবিরের ওয়ার্ড সভাপতি ফজলে রাব্বি সিফাতকে হত্যার উদ্দেশে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জখম করে। শুধু তাই নয়, জোরপূর্বক নিজেদের পক্ষে স্বীকারোক্তি নিতে একাধিকবার ছাত্রদল কর্মীরা নির্যাতন করে। আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বক্তব্য নিতে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা থানার সামনে মব তৈরি করার চেষ্টা করে। আমরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চিত করতে প্রশাসনের কাছে দাবি পেশ করছি। পাশাপাশি হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে ছাত্রদলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি
সম্প্রতি দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দায়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে ছাত্রশিবির। জাহিদুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়ন, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীর গজনী অবকাশ কেন্দ্র ও রাজধানী থেকে ছেড়ে যাওয়া রাজশাহীগামী একটি বাসে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ তিনটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমরা ধর্ষকদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রশাসনকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অথবা নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে জাতির নিকট ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
রাখাল রাহার গ্রেপ্তার ও পদত্যাগ দাবি
ইসলাম বিদ্বেষের দায়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির সদস্য রাখাল রাহাকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছে ছাত্রশিবির। জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা লক্ষ করেছি, মুক্ত চিন্তার নামে এ দেশে ইসলামবিদ্বেষী একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করছে। সেই গোষ্ঠীরই এক ক্রীড়নক এনসিটিবির পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির সদস্য রাখাল রাহা (সাজ্জাদুর রহমান) আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর শানে চরম অবমাননাকর ও ধৃষ্টতাপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন, যা ফৌজদারি আইন লঙ্ঘনের শামিল। আমরা অতি দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবি
এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবি জানিয়ে শিবির সভাপতি বলেন, আমরা গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি জুলাই গণহত্যায় জড়িতদের ৭২৩ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে। অথচ বিগত ১৫ বছরের দায়ের করা মামলার আসামিদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলামসহ সব মজলুমের দ্রুত মুক্তি দাবি করছি।
কিছু মিডিয়ার উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিবিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগ
কিছু মিডিয়া শিবিরের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচার করেছে বলে অভিযোগ করে জাহিদুল ইসলাম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে সব পক্ষ এক মোহনায় মিলিত হওয়ার ফলেই আমরা চেপে বসা পাহাড়সম জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু ফ্যাসিবাদ পরবর্তী বাংলাদেশে কিছু গণমাধ্যমের অপেশাদারি আচরণ আমাদের ব্যথিত করেছে। কিছু কিছু সংবাদ আমাদের কাছে একপেশে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আমরা মনে করি এগুলো মিডিয়ার ইচ্ছাকৃত ভুল নয়, অসাবধানতা বা তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনুসরণ করতে না পারার দরুন এমনটা হয়েছে।
শিবির সভাপতি বলেন, গত ১ জানুয়ারি বরগুনার পাথরঘাটায় পূর্ব শত্রুতার জেরে যুবদল কর্মী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। স্থানীয় মিডিয়া এবং পাথরঘাটা বিএনপির আহ্বায়ক উমর ফারুক সেই ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্মীকে দায়ী করে। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি জাতীয় একটি সংবাদমাধ্যম সেই ঘটনার তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে সংবাদ প্রচার করে।
তিনি আরও বলেন, একইভাবে কুয়েটের ঘটনাতেও আমরা লক্ষ করেছি শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের সংঘর্ষের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা না থাকলেও ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনাতেও কিছু সংবাদমাধ্যম উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। এ ছাড়াও আরও একাধিক ঘটনায় ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে অথচ ছাত্রশিবিরের সঙ্গে এসব ঘটনার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ, কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক ঢাবি শিবিরের সদ্য সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম এবং ঢাবি শাখা শিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ, সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কালের আলো/এসএকে