বইমেলায় ন্যাপকিন বিতর্ক
প্রকাশিতঃ 11:34 am | February 24, 2025

আমীন আল রশীদ:
বিতর্কের মধ্য দিয়ে শুরু এবারের অমর একুশে বইমেলা একের পর এক ঘটনায় সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে—যা এবার এসে ঠেকেছে স্যানিটারি ন্যাপকিনে। আর এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সামনে আসছে বাংলা একাডেমির মতো একটি মননশীল প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা, সাহস ও দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, নারী ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্যের ব্র্যান্ড ‘স্টে সেইফ’ বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে দুটি স্টল পরিচালনা করে আসছিল। মেলার শুরু থেকেই তারা স্টল চালিয়ে আসছিল। প্রথম দিকে কোনো সমস্যা না থাকলেও গত ১১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে বেশ কিছু ‘ইসলামিস্ট গ্রুপ’ ন্যাপকিনকে ‘গোপন পণ্য’ বলে আখ্যা দেয় এবং এর প্রকাশ্য প্রদর্শনী বা বিক্রি বন্ধের দাবি জানায়। পরদিন আরও অনেক মানুষ একই দাবি নিয়ে হাজির হয়। পরে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, আনসারসহ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। কিন্তু ১৩ ফেব্রুয়ারি কিছু গ্রুপ সরাসরি বাংলা একাডেমিতে অভিযোগ করে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে স্টল দুটি সরিয়ে নিতে চিঠি দেয় মেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান। ১৬ ফেব্রুয়ারি দুটি স্টল বন্ধ করে দেয় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
বইমেলা কমিটির সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক সরকার আমিন গণমাধ্যমকে বলেন, বইমেলার নীতি অনুযায়ী মেলায় বই ও খাবার ছাড়া অন্য কিছু বিক্রির সুযোগ নেই। তাই স্টল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন বলে নয়, যে কোনো অনুমোদনহীন পণ্যের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
যারা নানা ইস্যুতে মব তৈরি করছে বা করতে চাচ্ছে, তারা আদৌ সরকারকে পাত্তা দেয় কি না এবং সরকার যেভাবে তাদের মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে, সেটি যথেষ্ট কি না? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকার এই গোষ্ঠীকে কীভাবে সামাল দেবে—যদি তারা নির্বাচনটিও তাদের মতো করে করতে চায়?
কিন্তু কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেন। বিশেষ করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে একাডেমি কর্তৃপক্ষ মাথানত করেছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। শুধু তাই নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজমকে মেনশন দিয়ে এই ঘটনার সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট করেন।
নুসরাত লিখেছেন: ‘স্যার, ছিহ!! স্যানিটারি ন্যাপকিন গোপন পণ্য? পৃথিবীর সমস্ত মেয়ের প্রতি মাসে মাসিক, রক্তপাত, তা নিবারণে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো একটা পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর সামগ্রির খবর কি নাসা থেকে গতকাল পয়দা হয়েছে? তার আগে পৃথিবীর কেউ জানত না? আপনি কিভাবে পারলেন এই জিনিসটা এক্সেপ্ট করতে!!? বাংলা একাডেমির ধ্বজাধারী হওয়ার আগে আপনি একজন শিক্ষক সেটা কি ভুলে গেছেন? আপনি ব্যবসায়িক স্বার্থ মাথায় রাখলেন আর নারীদের মানুষ হিসেবে মিনিমাম স্বার্থ স্বীকার করলেন না!?’
একই দিন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বয়ং সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লেখেন: ‘স্যানিটারি ন্যাপকিন খুবই স্বাভাবিক একটা জিনিস। সরকার এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে উইমেন হেলথ হাইজিন নিয়ে সারাদেশে সচেতনতা তৈরি করেছে এবং করছে, সেখানে যে কোনো কারণেই হোক বইমেলায় এটাকে নিয়ে এই আলোচনাটা যে হইতে হলো, এটা আমাদের জন্য বেদনার। এই বিষয়ে যেসব ভাই-বোনেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাদের সবার বক্তব্যের সাথে আমরাও একমত। আপনাদের বিস্ময় এবং ক্ষোভ আমাদেরও।’
গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে অবশেষে অবস্থান পরিবর্তন করে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ জানায়, বইমেলায় বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ অব্যাহত থাকবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রসার ও ব্যবহার সম্পর্কে বাংলা একাডেমির কোনো প্রকার সংকোচ নেই। বরং বইমেলার পণ্যায়নের একটা ব্যাপার স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে অন্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে একাডেমির তরফে দুঃখপ্রকাশ করা হয়। বলা হয়, মেলার ইভেন্ট ওয়াশ রুমের পাশে বিনা মূল্যে প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা রাখা নিশ্চিত করবে একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বইমেলার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং ডায়াপার বিষয়ে একাডেমিকে জানিয়েছিল, ওয়াশ রুমের পাশে রেখে নারী ও শিশুদের প্রয়োজনমতো বিনা মূল্যে এসব পণ্য সরবরাহ করবে। কিন্তু মেলা কর্তৃপক্ষ দেখতে পায়, তারা এ দুই পণ্যসহ আরও কিছু পণ্য বিক্রি করছে। ফলে তাদের স্টল বন্ধ করতে বলা হয়। শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিন নয়; ডায়াপার, পেস্ট ও ব্রাশসহ আরও কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
বাংলা একাডেমির এই অবস্থান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো কেন? সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী, সমন্বয়ক এমনকি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তরফে যে এই ঘটনায় এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া আসবে, সেটি কি একাডেমি কর্তৃপক্ষ আন্দাজ করতে পারেনি? তারা কি ভেবেছিল এটি খুবই মামুলি একটা ব্যাপার।
বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদর্শনী এমনকি বিক্রি হওয়া না হওয়াটা আসলেই মামুলি ব্যাপার। বছরের পর বছর ধরে বইমেলা হচ্ছে অথচ কোনোদিন এই ইস্যু নিয়ে এরকম পরিস্থিতি হয়নি। কেউ বিশেষভাবে খোঁজও নেয়নি যে মেলায় বইয়ের বাইরে আর কী কী বিক্রি হচ্ছে? একসময় যখন বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানের রাস্তাও বইমেলার অংশ ছিল, তখন সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্য এমনকি শিশুদের নানাবিধ খেলনাও বিক্রি হতো। অর্থাৎ বইমেলা ঘিরে আরও নানারকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসতেন বিক্রেতারা। সেটি নিয়েও গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যে খুব বেশি সমালোচনা হয়েছে তা নয়। কিন্তু এবার কেন হলো? তাও স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো একটি অতি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে? কেন একটি গোষ্ঠী এটিকে ‘গোপন পণ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে এই পণ্য প্রদর্শনের কারণে বইমেলার ‘পবিত্রতা’ ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করার সাহস পাচ্ছে এবং একাডেমি কর্তৃপক্ষ কেন এই গোষ্ঠীকে ভয় পেয়ে মবের আশঙ্কায় তাদের কাছে মাথানত করলো? এই গোষ্ঠীটি কি রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী?
যারা নারীকে এখনো মানুষ ভাবতে অভ্যস্ত নয়, যারা নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দি থাকাকেই স্বাভাবিক মনে করে, নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার সামগ্রী যাদের কাছে ‘গোপন পণ্য’ এবং সেই পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করলে বইমেলা ‘অপবিত্র’ হয় বলে যারা মনে করে, তাদের চিন্তা ও বোধ যে এখনো আদিম; আধুনিক পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের যে একটি বিরাট দূরত্ব থেকে যাচ্ছে সেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী? সমাজের একটি ছোট অংশও যদি এ ধরনের চিন্তা ও বোধ নিয়ে বসবাস করতে থাকেন, তাহলে তারা আজ স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, তো কাল টয়লেট টিস্যুর বিরুদ্ধে বলবেন। পরশু তারা বলবেন বইমেলা কোনো নারী আসতে পারবেন না বা এলেও তাদের নির্ধারিত পোশাক পরে আসতে হবে।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে ধর্মের নামে যেভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে; বাধার মুখে উত্তরায় বাতিল বসন্ত উৎসবসহ অনেকগুলো গানের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে; নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার কড়া বিবৃতির এক সপ্তাহ না যেতেই একই ঘটনার যেভাবে পুনরাবৃত্তি হয়েছে, তাতে এই প্রশ্ন তোলাও অযৌক্তিক নয় যে, যারা নানা ইস্যুতে মব তৈরি করছে বা করতে চাচ্ছে, তারা আদৌ সরকারকে পাত্তা দেয় কি না এবং সরকার যেভাবে তাদের মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে, সেটি যথেষ্ট কি না? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকার এই গোষ্ঠীকে কীভাবে সামাল দেবে—যদি তারা নির্বাচনটিও তাদের মতো করে করতে চায়?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।