অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান

প্রকাশিতঃ 12:00 am | February 26, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের গভীর কাঠামোগত সঙ্কটগুলো উন্মোচিত হয়েছে। সর্বব্যাপী সঙ্কটে দেশে একটি অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকর ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বিরাজমান সঙ্কটের টেকসই সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় ঐক্য। এই ঐকমত্য নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার বদলে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে অনৈক্য, রেষারেষি ও তিক্ততা ক্রমশ জটিল করে তুলেছে দেশের পরিস্থিতিকে। নাজুক হয়ে ওঠেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও। এমন জটিল পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর রাওয়া কনভেনশন হলে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবসের’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে যেন অন্তরাত্মার ডাকেই সাড়া দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। নিজেরা হানাহানিতে লিপ্ত থাকলে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে, এমন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন তিনি।

বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস ও মর্মান্তিক ঘটনার একটি বাংলাদেশের পিলখানা ট্রাজেডি বা বিডিআর বিদ্রোহ। পিলখানায় বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহী জওয়ানেরা নৃশংসভাবে হত্যা করেন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। হত্যাযজ্ঞ আর বীভৎসতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সেই মর্মন্তুদ ঘটনার ১৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু ১৬ বছর যাবত চলতে থাকা এই বিচার নিয়ে অনেকেই এখন নিজেদের মর্জি-মাফিক নানা কথা বলছেন। বিশেষ তদবিরের মাধ্যমে নিজেদের হীন স্বার্থ বাস্তবায়ন করার অপকৌশলের কথাও শোনা যায় কান পাতলেই। এসব বিষয় নিয়ে এবার সরাসরি মুখ খুলেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘একটা জিনিস আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, এই বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য করেনি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিজিবি (বিডিআর) সদস্য দ্বারা সংঘটিত। ফুলস্টপ। এখানে কোনো “ইফ” এবং “বাট” (যদি ও কিন্তু) নাই। এখানে যদি “ইফ” এবং “বাট” আনেন, এই যে বিচারিক কার্যক্রম এত দিন ধরে হয়েছে, ১৬ বছর ধরে, ১৭ বছর ধরে যারা জেলে আছে, যারা কনভিকটেড, সেই বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এই জিনিসটা আমাদের খুব পরিষ্কার করে মনে রাখা প্রয়োজন। এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না। যে সমস্ত সদস্য শাস্তি পেয়েছে, তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।’ দেশ, জনগণ ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে আপোসহীন সেনাপ্রধান বিনয়াবনত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন- ‘আমাদের আক্রমণ করবেন না, আমাদের অনুপ্রাণিত করেন, আমাদের উপদেশ দেন।’ তাঁর দীর্ঘ এই বক্তব্য হয়ে ওঠেছে টক অব দ্য কান্ট্রি।

অনলাইন থেকে অফলাইন সর্বত্রই আলোড়ন তুলেছে সেনাপ্রধানের সময়োপযোগী, সাহসী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী বক্তব্য। ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দেশের চরম দু:সময়ে তাঁর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য শিক্ষাঙ্গণ থেকে কর্মক্ষেত্র, পরিবার থেকে সমাজ সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে। দেশের মানুষের কল্যাণই যে তাঁর এবং দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর পরম আরাধ্য সেই বিষয়টিও পরিস্কার করেছেন। বিভিন্ন সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিবে, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ ছাড়া এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয় ইত্যাকার আলোচনার বিপরীতে আবারও নিজের অবস্থান পরিস্কার করেছেন তিনি। অতীতের মতো এবারও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতার বিষয়ে তাঁর কোন লোভ-লালসা বা আকাক্সক্ষা নেই। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের সময়েই তাঁর সামনে সুযোগ ছিল ক্ষমতা গ্রহণের। কিন্তু তিনি সেটি না করে অন্তর্বর্তী সরকারকে সব রকমের সহায়তা দিয়ে আসছেন। এদিন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আবারও বলেছেন, ‘আমার একটাই  আকাঙ্ক্ষা, দেশ এবং জাতিটাকে একটি সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটি করা। আই হ্যাড এনাফ, ফর লাস্ট সেভেন-এইট মান্থস, আই হ্যাড এনাফ (আমার যথেষ্ট হয়েছে, গত সাত-আট মাসে যথেষ্ট হয়েছে)। আমি চাই, দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব।’

  • বিডিআর সদস্য দ্বারা সংঘটিত, ফুলস্টপ, কোনো ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ নাই
  • পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না
  • নিজেরা কাদা-ছোড়াছুড়ি করলে দেশ ও জাতি বিপন্ন হবে
  • ‘অরাজক পরিস্থিতির’ সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা
  • একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আশাবাদ
  • সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণ করবেন না
  • আলোড়ন তুলেছে সেনাপ্রধানের সময়োপযোগী, সাহসী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী বক্তব্য

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর এদিনের বক্তব্যটি লিখিত ছিল না মোটেও। তিনি দীর্ঘদিনের উপলব্ধিতেই বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন একজন নাগরিকের আকাঙ্ক্ষা ধারন করে দেশের মঙ্গল ও কল্যাণকর পথ দেখিয়েছেন। সমস্যার মূলে পৌঁছে যৌক্তিক সমাধানের দিকনির্দেশ করেছেন। পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছে সেখানে দেশপ্রেমিক সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের অপরিহার্য অঙ্গে রূপ নিয়েছে সেই বিষয়টিও খোলাসা করেছেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বর্তমান সঙ্কট দেখিয়েছে কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কৃতিই সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করে। সেনাপ্রধান নিজের দীর্ঘ বক্তব্যে এসব খুঁটিনাটি নানাদিক বুদ্ধির সঙ্গে যুক্তির যুগপৎ সম্মিলনে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। হৃদয়-মন থেকেই কথা বলেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন-‘একটু মন খুলেই কথা বললাম। এত দিন যে কথা মনের মধ্যে ছিল, সব সময় প্রকাশ করতে পারি না, প্রকাশ করাও যায় না। আজকে প্রকাশ করে ফেললাম।’

দ্রুত সময়ের মধ্যেই একটি নির্বাচনের ইঙ্গিত করেছেন। তিনি এই বিষয়ে বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য দিকে ধাবিত হচ্ছি। তার আগে যে সমস্ত সংস্কার করা প্রয়োজন অবশ্যই সরকার সেদিকে হেল্প করবেন। আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি, হি কমপ্লিটলি অ্যাগ্রিড উইথ মি। দেয়ার শুড বি ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন অ্যান্ড দ্যাট ইলেকশন শুড বি উইথইন ডিসেম্বর, অর ক্লোজ টু দ্যাট। যেটা আমি প্রথমেই বলেছিলাম যে ১৮ মাসের মধ্যে একটা ইলেকশন। আমার মনে হয় যে সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এ দেশটাকে ইউনাইটেড রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন উনি। ওনাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। উনি যেন সফল হতে পারেন। সেদিকে আমরা সবাই চেষ্টা করবো। আমরা একসঙ্গে ইনশাআল্লাহ কাজ করে যাবো।’ তাঁর এই বক্তব্য মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুর থেকেই রাজধানীর মিরপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় নাগরিকদের ইতিবাচক আড্ডা-আলোচনা হয়েছে।

বিডিআর সদস্য দ্বারা সংঘটিত, ফুলস্টপ, কোনো ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ নাই
পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, একটা জিনিস সব সময় মনে রাখতে হবে, এই বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য করেনি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিডিআর সদস্য দ্বারা সংঘটিত। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট না করার জন্য আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এই জিনিসটা আমাদের খুব পরিষ্কার করে মনে রাখা প্রয়োজন, এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না। যে সমস্ত সদস্য শাস্তি পেয়েছে, তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।’

এই প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আজকে একটা বেদনাবিধুর দিবস। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা এই ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসার এবং শুধু তাই নয়, তাঁদের কিছু কিছু পরিবারের সদস্যদের আমরা হারিয়েছি। এখানে আসার সময় এই ছবিগুলো আমি দেখছিলাম। এই ছবিগুলো আপনারা অনেকে ছবিতে দেখেছেন। কিন্তু এগুলো আমার সব চাক্ষুষ দেখা। আমি একটা চাক্ষুষ সাক্ষী এই সমস্ত বর্বরতার।’

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘এখানে কোনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এর মধ্যে উপস্থিত ছিল কি না, ইনভলব ছিল কি না, বাইরের কোনো শক্তি এর মধ্যে ইনভলব ছিল কি না, সেটার জন্য কমিশন করা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান এখানে আছেন। উনি এটা বের করবেন এবং আপনাদের জানাবেন।’ তিনি বলেন, ‘বটমলাইন হচ্ছে যে এই সমস্ত, আমাদের এই চৌকস সেনাসদস্য, যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন তদানীন্তন বিডিআর সদস্যদের গুলিতে। আমরা নিজেরা এসব জিনিস নিয়ে অনেক ভিন্নমত পোষণ করছি কেউ কেউ। এই জিনিসটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছি। সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।’

তিনি বলেন, ‘আজকে যদি আমার যে উপদেশ আমি কিছু দিয়ে যাব, সেটা যদি আপনারা গ্রহণ করেন, আপনারা লাভবান হবেন। আমি এটা আপনাদের নিশ্চিত করছি। আমরা নিজেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি। আমরা নিজেরা ইউনাইটেড (ঐক্যবদ্ধ) থাকি। আমাদের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, কোনো ব্যত্যয় থেকে থাকে, কোনো গ্রিভনসেস (দুঃখ-দুর্দশা) থাকে, সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধা করব। এটার জন্য ডানে-বাঁয়ে দৌড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। নিজের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না। আমি আপনাদের এই জিনিসটা নিশ্চিত করে দিচ্ছি।’

এই চার তারকা জেনারেল বলেন, ‘কিছু কিছু সদস্যদের দাবি যে তাঁরা ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন শাস্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ দায়ী করছেন যে তাঁরা অযাচিতভাবে শাস্তি পেয়েছেন। সেটার জন্য আমি একটা বোর্ড করে দিয়েছি। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেই বোর্ডের সদস্য। প্রথম ফেজে (পর্যায়ে) ৫১ জন সদস্যের ব্যাপারে আমার কাছে রিকমেন্ডেশন (সুপারিশ) নিয়ে এসেছে। তাঁর রিকমেন্ডেশনের (সুপারিশ) অধিকাংশই আমি গ্রহণ করেছি এবং আরও বেশি আমি গিয়েছি। নেভি, এয়ারফোর্সও (নৌবাহিনী-বিমানবাহিনী) তাদের এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমার স্ট্যান্ড পয়েন্ট (অবস্থান) হচ্ছে, যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, সেটার জন্য কোনো ছাড় হবে না। বিন্দুমাত্র ছাড় নাই। আমি আপনাদের পরিষ্কার করে দিচ্ছি, ইট ইজ আ ডিসিপ্লিনড ফোর্স (এটা একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী)। ডিসিপ্লিনড ফোর্সকে ডিসিপ্লিনড থাকতে দেন।’

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আজকে এই দেশের ক্রান্তিলগ্নে সমস্ত বাহিনী, সমস্ত অর্গানাইজেশন (প্রতিষ্ঠান) বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। খালি সেনাবাহিনী টিকে আছে। বিমানবাহিনী টিকে আছে। নৌবাহিনী টিকে আছে। কেন? বিকজ অব ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলার জন্য)। তারপরও আমি আমার অফিসারকে আদেশ দিয়েছি। যদি সামান্যতম কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে, কারও বিরুদ্ধে যে অ্যাকশন (শাস্তিমূলক ব্যবস্থা) নেওয়া হয়েছে, অপরাধী কি না, যদি সামান্য কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে, সেটা তাদের ফেভারে (পক্ষে) যাবে। এটা হচ্ছে আমার ঢালাও নির্দেশ। সেই হিসেবে বিভিন্ন প্রস্তাব আমার কাছে এসেছে। কোনো কোনো প্রস্তাবে আমি আরও আমার নিজে থেকে যোগ করে আরও বেশি আমি দিয়েছি। এভাবে পর্যায়ক্রমে অফিসাররা অ্যাপিয়ার করবে, আসবে এবং তাদের এই জিনসগুলো আমরা দেখব। দেখে যদি মনে হয় যে তাঁদেরকে কিছু করার অবকাশ আছে, অবশ্যই আমরা করব। ন্যায়নীতিতে আমরা প্রতিষ্ঠিত থাকব, ইনশা আল্লাহ।’

অতিথিদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আপনারা কিছু মনে করবেন না। আজকে আমি একটু পরিষ্কার করে কথা বলতে চাই। আপনাদের সবার হয়তো ভালো না–ও লাগতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, আমার এটা যদি আপনারা গ্রহণ করেন, আপনারা লাভবান হবেন। কোনো ক্ষতি হবে না…। আমার অন্য কোনো আকাক্সক্ষা নাই।’

নিজেরা কাদা-ছোড়াছুড়ি করলে দেশ ও জাতি বিপন্ন হবে
নিজেরা কাদা-ছোড়াছুড়ি, মারামারি ও কাটাকাটি করলে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে বলে সতর্ক করেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এই দেশ আমাদের সবার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সবাই সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা চাই না হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি।’ দেশ-জাতি যেন একসঙ্গে থাকতে পারে, সে লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মতের বিরোধ থাকতে পারে, চিন্তাচেতনার বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু দিন শেষে দেশ ও জাতির দিকে খেয়াল করে আমরা সবাই যেন এক থাকতে পারি। তাহলেই এই দেশটা উন্নত হবে, এই দেশটা সঠিক পথে পরিচালিত হবে। না হলে আমরা আরও সমস্যার মধ্যে পড়তে যাব। বিশ্বাস করেন, ডোন্ট ওয়ান্ট টু হেড, ওই দিকে আমরা যেতে চাই না।’

এ প্রসঙ্গে সতর্কবার্তা উল্লেখ করে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন যে আমি সতর্ক করিনি। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা–ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজকে বলে দিলাম নইলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের। এই দেশ আমাদের সবার। আমরা সবাই সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা চাই না হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি।’ সবাই যেন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে, সে লক্ষ্যে সেনাবাহিনী কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন সেনাপ্রধান।

‘অরাজক পরিস্থিতির’ সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, ‘দেশে এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের পেছনে কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণটা হচ্ছে যে আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা খুব ভালোভাবেই জানে যে এই সময়ে যদি এই সমস্ত অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সেই কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত থাকি, একত্রিত থাকি, তাহলে অবশ্যই এটা সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।’

সেনাপ্রধান বলেন, ‘পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই-এগুলো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে অতীতে। খারাপ কাজের সাথে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে। আজকে যে দেশের স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সেনাসদস্য, সিভিলিয়ান-সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে, অসামরিক-সামরিক সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে ইফেক্টিভ (কার্যকর) রেখেছে। সেই জন্য আজকে, এত দিন ধরে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি। এর মধ্যে যারা কাজ করেছে, যদি অপরাধ করে থাকে, সেটার শাস্তি হবে। অবশ্যই শাস্তি হতে হবে। না হলে এই জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমনভাবে কাজটা করব, এই সমস্ত অর্গানাইজেশনগুলো যেন আন্ডারমাইন না হয়।’

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আজকে পুলিশ সদস্য কাজ করছে না। একটা বড় কারণ হচ্ছে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা। অনেকে জেলে। র‌্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই প্যানিকড (আতঙ্কিত)। বিভিন্ন দোষারোপ, গুম-খুন ইত্যাদির তদন্ত চলছে। অবশ্যই তদন্ত হবে। দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এমনভাবে কাজটা করতে হবে, যেন এই অর্গানাইজেশনগুলো আন্ডারমাইন না হয়। এই অর্গানাইজেশনগুলোকে যদি আন্ডারমাইন করে আপনারা মনে করেন যে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে, সবাই শান্তিতে থাকবেন, এটা হবে না। সেটা সম্ভব না। আমি আপনাদের পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি।’

এই দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীর নয় উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘দুই লক্ষ পুলিশ আছে। বিজিবি আছে, র‌্যাব আছে, আনসার–ভিডিপি আছে। আমার আছে হচ্ছে ৩০ হাজার সৈন্য। এদেরকে আমি এই যে একটা বিরাট ভয়েড (শূন্যতা), আমি এই ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে আমি কীভাবে এটা পূরণ করব? ৩০ হাজার থাকে, আবার ৩০ হাজার চলে যায় ক্যান্টনমেন্টে, আরও ৩০ হাজার আসে। এটা দিয়ে আমরা দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

এ প্রসঙ্গে আলোচনায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আরও বলেন, ‘এখানে যেসব উচ্ছৃঙ্খল কাজ হয়েছে, সেটা আমাদের নিজস্ব তৈরি। এটা আমাদের নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচারড, আমরা নিজেরা এইগুলো তৈরি করেছি। এই বিপরীতমুখী কাজ করলে দেশে কখনো শান্তিশৃঙ্খলা আসবে না, এই জিনিসটা আপনাদের মনে রাখতে হবে।’

‘সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণ করবেন না’
বক্তব্যে সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণাত্মক কথা না বলার আহ্বান জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, ‘একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারও কারও। কী কারণে আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে। অবকোর্স নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স, নেভি চিফ আবার মন খারাপ করে আবার ইয়ে করছে। নেভি, এয়ারফোর্স উই অল। আমাদের সাহায্য করেন, আমাদের আক্রমণ করবেন না। আমাদের অনুপ্রাণিত করেন, আমাদের উপদেশ দেন। …আমাদের প্রতি আক্রমণ করবেন না। উপদেশ দেন, আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করব। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই এবং দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’

কালের আলো/এমএএএমকে