ইফতারের আগে ঢাকার সড়ক যেন যুদ্ধক্ষেত্র
প্রকাশিতঃ 12:33 am | March 04, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
বিকেল পৌনে ৪টা থেকে শুরু হয়। যা চলে ইফতারের পর্যন্ত। বলছি ঢাকার সড়কের যানজটের কথা। প্রতিদিন এসময় সড়কের চিত্র দেখে যে কারও মনে হবে, এটি সড়ক নয় যেন যুদ্ধক্ষেত্র। সবার লক্ষ্য একটাই ইফতারের আগে ঘরে ফেরা। যে যেভাবে পারছে সোজা, উল্টো, ফুটপাত সব উপায়ে ঘরে ফেরাই লক্ষ্য।
সরেজমিন দেখা যায়, সোমবার (৩ মার্চ) ইফতারের আগ পর্যন্ত যেন সড়কে আটকা ছিল ঘরমুখো মানুষ। চারদিকে শুধু যানবাহন আর যানবাহন। তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না সড়কে। ভোগান্তিতে পড়া অনেক ঘরমুখো মানুষকে বাধ্য হয়ে সড়কেই সারতে হয়েছে ইফতার।
যানজটের নিউজ সংগ্রহ করতে গিয়ে এই প্রতিবেদকেরও সড়কেই ইফতার করতে হয়।
সোমবার (৩ মার্চ) বিকেল ৪টায় সেগুনবাগিচা থেকে বের হয়ে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ভবনের পাশ দিয়ে কাকরাইল ঢুকতেই দেখা মেলে যানজটের। সেখান থেকে ৩০ সেকেন্ডের পথ কাকরাইল মোড়। তা পাড়ি দিতে লেগে যায় ২০ মিনিট। কাকরাইল মোড় থেকে মিন্টো রোড পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লেগে যায় ৫০ মিনিট। সড়কের অবস্থার উন্নতির আশায় ১০ মিনিটের বিরতি দিয়েও কোনো পরিবর্তন না দেখে আবারও আফতাব নগরের উদ্দেশ্যে রওনা করে এই প্রতিবেদক। ৫টা ২০ মিনিটের দিকে ফের রওয়ানা দিয়ে মিন্টো রোড থেকে মগবাজার ফ্লাইওভার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল হয়ে হাতিরঝিল প্রবেশ করে পুলিশ প্লাজার সামনে যেতেই ইফতারের সময় হয়ে যায়। আটকা থাকা মানুষের সড়কেই ইফতার করতে হয়। কেউ পানি মুখে দেন, কেউ খেজুর, কাউকে আবার দাঁড়িয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে পানি কিনে ইফতার সারতে দেখা যায়।
নিম্ন আদালতের আইনজীবী নাইমুর রহমান বলেন, বিকেল সাড়ে ৩টায় মগবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে পৌঁছাতে পেরেছি ইফতারের ২০ মিনিট আগে। যানজটে বসে বসে শুধু ভাবছিলাম, এ কেমন যানজট। দীর্ঘ ১২ বছরের অভিজ্ঞতায় এমন ভোগান্তিতে কম পড়েছি। সড়কে চাপ থাকলে ধীর গতিতে হলেও যানবাহন চলতো। আজ যেন সব স্থবির হয়েছিল দীর্ঘসময়।
রাজধানীর আগারগাঁও এলাকা থেকে আফতাব নগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে নাবিস্কো পর্যন্ত পৌঁছাতে স্বস্তির কথা জানান গণমাধ্যমকর্মী আমিনুল ইসলাম। কিন্তু এরপর তার তিন কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিতে যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা হয়।
তিনি বলেন, আগারগাঁও থেকে তেজগাঁও পৌঁছেছি যানজট ছাড়া। এরপর যেন চারদিক বন্ধ। কোনো দিকে বের হওয়ার মতো পথ নেই। সামনেও যাওয়া যাচ্ছে না, পেছনেও না। উল্টো পথে যাওয়ার সুযোগ নেই। একরকম অসহায় দশা। বাড্ডায় পৌঁছেছি ইফতারের কিছুক্ষণ আগে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, হাতিরঝিল, বাড্ডা ইউলুপ, রামপুরা ব্রিজ সব পথেই স্থবির হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থার উন্নতি ঘটে ইফতারের পর।
পুলিশ প্লাজার সামনে এক পাঠাও বাইক চালক বলেন, তিন বছর ধরে ঢাকায় বাইকার হিসেবে কাজ করছি। কোনো রমজানে এমন ভোগান্তিতে পড়িনি। জাস্ট বসে থাকা। কিছুক্ষণ পর দু-এক পা এগিয়ে আবার স্টার্ট বন্ধ করে বসে থাকা। এভাবে পুলিশ প্লাজার সামনে গিয়ে আজান শুনে ব্যাগ থেকে পানি বের করে যাত্রীসহ ইফতার সেরেছি।
সিএনজি চালক আব্দুর রশিদ বলেন, কাকরাইল থেকে গন্তব্য গুলশান-২। ভেবেছিলাম মহাখালী-বনানী হয়ে গুলশান ঢুকতে ৫টার পর ব্যাপক যানজটে পড়ব। এই ভেবে মগবাজার ফ্লাইওভারে না ওঠে হাতিরঝিলে ঢোকার জন্য নিচ দিয়ে রওনা দিই। কিন্তু ভয়াবহ যানজটে পড়তে হয়। কোনো রকম হাতিরঝিলে ঢুকতেই আবারো যানজট। যে যানজট ধুঁকতে ধুঁকতে পুরান আড়ং ভবনের সামনে গিয়ে আজান পড়ে যায়।
তিনি বলেন, খুব খারাপ লাগছিল। দুজন যাত্রী রাস্তায় ইফতারের অনেক কেনাকাটাও করল। বাসায় সবাই অপেক্ষায়। কিন্তু তারা ইফতারের আগে পৌঁছতে পারিনি গন্তব্যে। ইফতারের সময় মুখে পানি দিতে দিতে চোখ ভিজে গেল তাদের। যা দেখে ভীষণ খারাপ লাগছিল আমার।
তবে যানজট কমাতে ও সড়ক গতিশীল রাখতে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে সড়ক শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদেরও।
ট্রাফিক-তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-তেজগাঁও) তানিয়া সুলতানা বলেন, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের স্বল্প জনবল নিয়েই কাজ করছি। বিজয় সরণিতে সমস্যা ছিল না। আমি নিজেও সোনারগাঁও ক্রসিংয়ে ছিলাম। গুলশানে কোনো একটা ইস্যু ছিল। যেটার প্রভাবে মহাখালী থেকে ঠিকমতো গাড়ি টানতে পারিনি। সেটার রেশ তেজগাঁও এলাকায় পড়েছে।
ট্রাফিক-গুলশান বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-গুলশান জোন) আবু সায়েম নয়ন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি কিন্তু ইফতারের আগে সব যানবাহন রাস্তায় নেমে পড়ে। বিকল্প রাস্তা নেই। আর সোমবার-মঙ্গলবার গুলশানে প্রেসার বেশি থাকে। আজকে বনানীতে পূজা মণ্ডপে সমাবেশ ছিল। আর রোজার প্রথম দিকে প্রেসার থাকেই। সবমিলিয়ে প্রেসার ছিল।
ট্রাফিক রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-রমনা বিভাগ) কাজী রোমানা নাসরিন বলেন, রমনা সড়কের যে ধারণক্ষমতা তার চেয়ে কয়েকগুণ যানবাহন যখন নেমে পড়ে তখন কিছুই করার থাকে না। সবার লক্ষ্য যেন একসঙ্গে বাড়ি ফেরা। এখান থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব! আমাদের সবাইকে মাইন্ডসেট চেঞ্জ করতে হবে। সবার ম্যাপ দেখে চলা উচিত। একটু ঘুরে হলেও লাল এলাকা এড়িয়ে চলা উচিত। তাহলে যানজট কমবে।
কালের আলো/এমএএইচ/ইউএইচ