সরকারকে ‘বেকায়দায়’ ফেলতেই কী ঘন ঘন অগ্নিকান্ড?

প্রকাশিতঃ 12:11 pm | March 31, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

বিষয়গুলো কী কেবল কাকতালীয়ই! চুড়িহাট্টার পর বনানীর এফ আর টাওয়ারে বিভীষিকাময় অগ্নিকান্ড। আগুনে পুড়ে কঙ্কাল মানুষ। সময়ের ব্যবধান মাত্র ৩৬ দিন। আবার আকাশছোঁয়া এফ আর টাওয়ারে আগুনের মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটের কাঁচাবাজারে অগ্নিকান্ড।

চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের মাত্র সাত দিনের মাথায় গভীর রাতে মিরপুর ভাষানটেকের জাহাঙ্গীর বস্তিতে আগুন। ওই সময় পুড়েছিলো বস্তির প্রায় হাজারখানেক ঘর।

আরো পড়ুন:
চ্যালেঞ্জের মুখে মেয়র আতিকুল ইসলাম?

চুড়িহাট্টায় ৭১, এফ আর টাওয়ারে ২৬ আর গুলশানের কাঁচাবাজারে ছাই হয়েছে দুই শতাধিক দোকান। গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের আগুনের রেশ কাটতে না কাটতেই বিকেলে গুলশান-২’র ডেল্টা লাইফ টাওয়ারে অগ্নিকান্ড। শনিবার (৩১ মার্চ) দিনগত মধ্যরাতে নরসিংদীর একটি জুটমিলেও আগুন লেগেছে। এতে ভস্মীভূত হয়েছে পাটের রোল।

ঘন ঘন এসব অগ্নিকান্ডকে কেবল দুর্ঘটনা ভাবার কোন কারণ নেই বলে মনে করেন অনেকেই। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই পরিকল্পিত নাশকতার মাধ্যমে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কীনা এই বিষয়সমূহও তদন্ত করে দেখার দাবি উঠেছে।

শনিবার (৩০ মার্চ) দুপুরে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় এসব অগ্নিকান্ডগুলো যে নিছক দুর্ঘটনা নয় নাশকতাও হতে পারে সেই কথা উচ্চারণ করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।

তিনি বলেছেন, ‘এসব ঘটনা শুধুই দুর্ঘটনা কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। অনেক সময় ব্যবসায়ীদের মধ্যে মনোমালিন্য বা ভুল-বোঝাবুঝির সুযোগ নিয়ে তৃতীয় পক্ষের কেউ এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকা দরকার।’

কালের আলো’র এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামও বলেছেন, ‘অবশ্যই এই বিষয়গুলোর তদন্ত হওয়া দরকার।’

এদিন শনিবার (৩০ মার্চ) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মেয়র আতিকুল বলেন, ‘গুলশান-১ এর উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেটে এর আগেও একবার আগুন লেগেছিল। এরপর তিন চারবার নোটিস দেওয়া হয় মার্কেট কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তারা কী ব্যবস্থা নিলো। আবার কেনো এই মার্কেটে আগুন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।’

রহস্যময় এসব অগ্নিকান্ডের কারণ খুঁজে বের করতে তৎপর রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ। এসব অগ্নিকান্ডের নেপথ্যে কোন ষড়যন্ত্র রয়েছে কীনা তাও অনুসন্ধান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। সরকারের শীর্ষ মহলও এসব বিষয়সমূহ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই দেখছে। চুড়িহাট্টা ও বনানীর এমন ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের পুরো বিষয়টি মনিটর করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চকবাজারের রাতের ঘটনায় তিনি ছিলেন নির্ঘুম। এই দু’টি ঘটনাতেই তিনি বিমর্ষ, চিন্তিত ও মর্মাহত।

তথ্যমন্ত্রী ড.হাছান মাহমুদ সেদিন বলেছিলেন, ‘আগুন ও ভবনটিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে চলা অভিযান সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগুন নিয়ন্ত্রণ ও হতাহতদের পাশে দাঁড়াতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটর করছেন প্রধানমন্ত্রী।’

চুড়িহাট্টার অগ্নিকান্ডে দগ্ধদের ওই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে দেখতে এসে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীও বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি সারাক্ষণ খোঁজখবর রাখছেন। বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে (প্রধানমন্ত্রী) কয়েকবার কথা বলেছেন। এখানে রোগীরা কেমন আছেন সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ করার জন্য উনি আমাদের সকলকে নির্দেশনা প্রদান করেছেন।’

জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গো হার হারার পর রাজনীতির মাঠ থেকে লেজ গুটিয়ে নিয়েছে সরকার বিরোধীরা। লন্ডনে অবস্থানরত পলাতক এক নেতার সব অপকৌশল বুমেরাং হয়ে যাওয়ায় কার্যত তাঁরা নিস্তেজ হয়ে পড়লেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ভয়াবহ অগ্নিকান্ড এবং সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিহ্নিত ওই চক্রটি নতুন নতুন ফাঁদ পেতে সরকারকে ঘায়েল করার অপচেষ্টা চালাতে পারে বলেও গুঞ্জণ রয়েছে। এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে- অগ্নিকান্ড ও সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষকে উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা।

সপ্তাহ দেড়েক আগে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা আবারো সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করে। ওই সময় সরকারের শীর্ষ মহলের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে শিক্ষার্থীরা আশান্বিত হয়ে অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করে।

সেই সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম মাত্র দুই দিনের মাথায় নিহত শিক্ষার্থী আবরারের নামে ওভার ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু করে দেন এবং কয়েক দফায় তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। এসবের ফলে মহল বিশেষের ভিন্নখাতে ঘটনাকে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র মাটিচাপা পড়ে এবং তাঁরা আপাতত পাততাড়ি গুটিয়ে নেয়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সরকার বিরোধীদের হাতে রাজনৈতিক কোন ইস্যু নেই এখন। সরকারকে কৌশলে বিপাকে ফেলতে কোন ইস্যু তৈরি করার জন্য কোন দেশী-বিদেশী কোন চক্র নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে কিনা তা খুঁজে বের করতে সক্রিয় রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাও।

শুধু নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত নাশকতা তা খুঁজে বের করতে গিয়ে অগ্নিকান্ডের পেছনে কোন ভবন মালিক, অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর জীবন বাঁচানোর সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করার পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়েও তদন্ত করে দেখবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।

চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ার মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পুনরাবৃত্তিরোধে তদন্ত কমিটি গঠন, থানায় মামলা দায়ের, দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করানো, আইন না মানা ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযান পরিচালনা, ত্রুটি ভবন নির্মাণের সহায়তা করার জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনী পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে সরকারের শীর্ষ মহল।

ইতোমধ্যেই শনিবার (৩০ মার্চ) দিবাগত রাত সাড়ে ১০টায় বারিধারার নিজ বাসা থেকে বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভবনের একাংশের মালিক বিএনপি নেতা তাসভির উল ইসলামকে এবং রাত ১ টার দিকে ভবনটির জমির মালিক এস এম এইচ ফারুককে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

কালের আলো/এএ