জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে বাংলাদেশ: আইন উপদেষ্টা

প্রকাশিতঃ 10:43 pm | March 05, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

দেশে গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ইতোমধ্যে ছয়টি কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তাদের যে সুপারিশমালা, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনের রিপোর্টের সঙ্গে সেগুলোর মিল আছে। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনার অফিসের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

বুধবার (৫ মার্চ) জেনেভায় জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ওপর ‘চার্টিং দ্য পাথ ফরোয়ার্ড’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মানবাধকার হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের তৈরি ‘যাত্রাবাড়ী: অ্যান এভিডেন্স টু ম্যাসাকার’ শীর্ষক তথ্যচিত্র দেখানো হয়। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহমুদুর রহমান, স্থপতি ফারহানা শারমিন ইমু, যিনি আহতদের চিকিৎসা দিয়েছেন, তিনিসহ ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের সদস্যরা এ সময় বক্তব্য রাখেন। এছাড়া নেদারল্যান্ডস ও সৌদি আরবের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চান।

আসিফ নজরুল জানান যে, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোকে আমরা সংস্কার কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করবো। তাদের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা শুধুমাত্র এই প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমেই শেষ হয়ে যাবে না।

তিনি বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনার অফিসের সঙ্গে কাজ করছি। আমরা ইতোমধ্যে একটি খসড়া টেক্সটে সম্মত হয়েছি। আমি মনে করি, আমরা একসঙ্গে অনেকদূর কাজ করতে পারবো।’

সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে যারা নির্যাতন করেছে এবং তাদের গুণ্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে নির্যাতন করে আসছিল। যারা আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের ওপর কিছু হামলা হযেছে। আমরা এটিকে নিন্দা জানাই। যাদের ওপর হামলা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই মুসলিম। অল্প কিছু সংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এ কারণে কেউ যদি এটিকে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়, তাহলে আমি এর সঙ্গে একমত হবো না।’

জাতিসংঘের প্রতিবেদন সঠিকভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে এনেছে। এরমধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে আটক, নির্যাতন এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থদের শক্তি প্রয়োগের ঘটনা রয়েছে। জাতিসংঘ তদন্ত করে যা পেয়েছে, সেটি দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি জানান।

আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, অন্তর্বর্তী সরকার একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ— যাতে করে জুলাই-আগস্ট ম্যাসাকারের সঠিক বিচার হয়। এজন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল ১৯৭৩-কে সংশোধন করা হয়েছে। যাতে করে সঠিক বিচার ও স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত হয়।’

তিনি জানান, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল ১৯৭৩ এর যে বিষয়গুলোতে সংশোধনী আনা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে— আন্তর্জাতিক মাপকাঠি অনুযায়ী অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ, অভিযুক্তদের নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার পরিধি বৃদ্ধি, বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের সুবিধা এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের বিচার চলাকালীন আদালতে উপস্থিতি বলে তিনি জানান।

অন্তর্বর্তী সরকার গুমকে দেশের পেনাল আইনে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংজ্ঞায়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের সময়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ এবং মেমোরিয়ালাইজেশনের জন্য জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান আইন উপদেষ্টা।

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা। আমরা বিশ্বাস করি, সাবেক সরকারের কর্মকর্তারা, আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের উগ্র সমর্থকরা নিয়মতান্ত্রিক ও সংঘবদ্ধভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এরমধ্যে শত শত আইন-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে আটক, নারী ও শিশুসহ অন্যদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে।’

সামনে কী আছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দায়বদ্ধতা সবচেয়ে জরুরি। এরজন্য প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। অনেকগুলো মামলা করা হয়েছে। অবশ্যই এখানে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডের প্রথা রহিত সংক্রান্ত জাতিসংঘের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার এবং আমরা চাই, মৃত্যুদণ্ড রহিতের মেয়াদ যেন আরও বাড়ানো হয়।’ এছাড়া সরকার চাইলে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করার জন্য অনুরোধ করতে পারে বলে তিনি জানান।

ভলকার তুর্ক বলেন, ‘আমি নিজে বাংলাদেশে একটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। আমি নিজের চোখে দেখেছি— কীভাবে তরুণ, শিশু ও নারীরা নির্যাতিত হয়েছে। তাদেরকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল এবং তাদের অনেককে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে।’

জাতিসংঘ যেসব সুপারিশ দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কীভাবে আমরা কাজ করবো, সেটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আমরা সহযোগিতা ও কারিগরি সহায়তা দিতে চাই।’

কালের আলো/এমডিএইচ