তবুও কেন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু পুলিশ?
প্রকাশিতঃ 10:42 pm | March 07, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আন্দোলন চলাকালে পুলিশের ভূমিকা ছিল কার্যত বিতর্কিত। অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। এরই জেরে বিক্ষুব্ধ জনতা ওই সময়ে থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। এসব ঘটনায় ৪৪ পুলিশ সদস্য নিহত হন। এমন পরিস্থিতিতে কর্মবিরতিতে বেশ কয়েকদিন বন্ধ ছিল পুলিশি কার্যক্রম, বন্ধ ছিল থানার কার্যক্রমও। পরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পুলিশ থানায় ফিরতে শুরু করে। গত ৭ মাসে থানাগুলোতে পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক হচ্ছে। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) থেকে শুরু করে নতুন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পুলিশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তবে এখনও বিভিন্ন সময় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে পুলিশ। এ ধরনের হামলার ঘটনাকে বাহিনীর মনোবলের ওপর বড় ধরনের আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিশেষ করে গত ৬ মাসে পুলিশের ওপর কমপক্ষে ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও হামলা করে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটানো হয়েছে উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণে বা ‘মব’ তৈরি করে। এতে পুলিশের মধ্যে পুনরায় এক ধরণের ভীতি কাজ করছে। ক’দিন আগে রাজধানীর কাওরানবাজার ও চট্টগ্রামের পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যদের সাথে উচ্ছৃঙ্খল ও সমাজবিরোধী কিছু ব্যক্তির অসৌজন্যমূলক ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি এক বিবৃতিতে এ ধরনের ঘটনাকে পুলিশ বাহিনীর জন্য ‘মর্মান্তিক, চরম উদ্বেগজনক ও আশাহত করার মতো’ বলে মনে করছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশকে আবারও কাছে টেনে নিতে নাগরিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই পুলিশকে খোলনলচে পাল্টে ‘জনগণের বন্ধু’ হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ভেঙে পড়া মনোবল ফিরিয়ে আনতে কঠোর সংগ্রাম করছেন। মাঠ পর্যায়ে নিজ বাহিনীর বিশৃঙ্খলা দূর করার প্রয়াস নিয়ে ছুটছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। দেশের মানুষের পালস বুঝে দুর্নীতিমুক্ত ও মানবিক পুলিশ উপহারের প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু এরপরেও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে একশ্রেণির অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরূপ আচরণের ঘটনা বাহিনীটিকে নতুন সঙ্কটে ফেলছে।
গত বৃহস্পতিবার (০৬ মার্চ) রংপুরে এক অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম পুলিশের কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের কারণে পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে মানুষের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। নাগরিক সমাজের প্রতি আমার অনুরোধ, পুলিশকে আপনারা আবার কাছে টেনে নিন। পুলিশকে কাজ করতে সহায়তা করেন।’
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৭০টি ঘটনা বড় ধরনের আলোচনা তৈরি করেছে। এর মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৩, জানুয়ারিতে ৩৮ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিটি ঘটনা ঘেঁটে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও মব তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছেন। আবার বিভিন্ন স্থানে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনাও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। গত এক সপ্তাহে এমন অন্তত চারটি ঘটনা ঘটেছে। দিন তিনেক আগে ভোলার বোরহানুদ্দিনে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে এক আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় হামলাকারীরা ছিলেন আসামির পরিবারের সদস্য। এই আক্রমণে আহত হয়েছেন পুলিশের এক সহকারী উপপরিদর্শক। আর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশের কাছ থেকে অন্তত ১৩টি আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও থানায় ঢুকে পুলিশ সদস্যদের শাসানো এবং রাজনৈতিক মঞ্চে প্রকাশ্যে পুলিশকে হুমকি এবং তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে দেখা গেছে।
অপরাধীরা পুলিশকে ভয় না পেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, মাদক কারবারিরাও যখন মব তৈরি করে পুলিশের ওপর হামলা করে, তখন এটি উদ্বেগের বিষয়। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে আইন প্রয়োগে পুলিশকে সহযোগিতা করতে হবে। হামলার ঘটনায় পুলিশকে নতি স্বীকার না করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে আরও কঠোর হতে হবে।
সূত্র জানায়, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হচ্ছে পুলিশ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বারবার পুলিশকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জনগণকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নির্দেশে ও আইজিপির তত্ত্বাবধানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র ডিএমপি’র ৫০টি থানা এলাকায় ৬৬৭টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৭১টি পুলিশ চেকপোস্টসহ সিটিটিসি, এটিইউ, এপিবিএন ও র্যাবের টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাতে ৩৪০টি ও দিনে ৩২৭টি টিম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত মোট ১৮৮ জনকে গ্রেফতার করেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জানমালের নিরাপত্তা ও অপরাধ দমনে নিরলসভাবে কাজ করছে। এটি জনগণের সেবায় নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের অবদান গর্বের অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। তবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় কিছু অসৎ ও অপেশাদার কর্মকর্তার ভূমিকার কারণে পুলিশের ভাবমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, যা পুলিশ বাহিনীর জন্য এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে বাহিনীর সদস্যরা নতুন উদ্দীপনা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করতে কিছু উচ্ছুঙ্খল ও শান্তি-ভঙ্গকারী ব্যক্তি পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে, যা জনমনে হতাশা তৈরি করছে। পুলিশ বাহিনী এসব চ্যালেঞ্জ পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে পুলিশ বাহিনী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কালের আলো/এমএএএমকে