কোন কাল্পনিক বয়ান নয়, অগ্নিঝরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অব্যর্থ হাতিয়ার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

প্রকাশিতঃ 11:43 pm | March 10, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে নতুন করে তত্ত্ব বা বয়ান করা হচ্ছে। একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে এখনও অবান্তর প্রশ্ন প্রকারান্তরে উন্মেষ ঘটিয়েছে আরও নতুন কিছু প্রশ্নের। এ নিয়ে ইতিহাসের বিচার, তর্ক-বিতর্ক আর বিভিন্ন পক্ষের বয়ানের পটভূমি থেকে গভীর আলোচনা-পর্যালোচনায় লিপ্ত রয়েছেন কেউ কেউ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সব শ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বত:স্ফূর্ত। এই অভ্যুত্থান সফলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী যে অন্যতম গাঠনিক শক্তি ছিল এই সত্য অস্বীকার করাও আদতে আত্মপ্রতারণার নামান্তর। দেশের সচেতন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা ও বিশ্লেষকরাও বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন ছাত্র-জনতার কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে সেনাবাহিনী শামিল না হলে ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। সেই সময়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর ‘নো ফায়ার’ নির্দেশনা পাল্টে দেয় পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপট। কিন্তু অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মতাদর্শিক বিতর্ক যখন তুঙ্গে ওঠেছে তখন এই বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে একটি চিহ্নিত মহল। সরল পথ পরিহার করে ধুম্রজাল তৈরি করছেন তাঁরা।

যেখানে সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধানের ভূমিকা একেবারেই স্পষ্ট সেখানে গুজব আর মিথ্যার বেসাতি ছড়ানোর মাধ্যমে বাহিনীটি ও বাহিনীর প্রধানকে বিব্রত করার কসরত চলছে একদিন-প্রতিদিন। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে দমনপীড়নে অংশ না নিতে সেনাবাহিনীকে সতর্ক করার পর দেশটিতে পরিবর্তন হয়, সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বিবিসির হার্ডটক অনুষ্ঠানে এমন কথা বলার পর স্বার্থান্বেষী মহল বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যা প্রকৃত অর্থেই সেনাবাহিনী সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। কোন কোন রাতকানা নিজেদের পক্ষে কাল্পনিক বয়ান তৈরির মাধ্যমে বাহিনীটির পেশাদারিত্বকেও মোটা দাগে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস শুরু করেছেন। কিন্তু একবাক্যে সবাই বলবেন, গণঅভ্যুত্থান সফলে সেনাবাহিনীর সাহসী, বলিষ্ঠ ও ঐতিহাসিক ভূমিকাকে বাদ দিয়ে ইতিহাস কল্পনা করা বাতুলতা মাত্র।

ভলকার তুর্ক এর এই বক্তব্য প্রচারের কয়েক দিনের মাথায় পুরো বিষয়টি খোলাসা করেছে সেনা সদর দপ্তর। তাঁরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার থেকে এ বিষয়ক কোনো ইঙ্গিত কিংবা বার্তা সম্পর্কে অবগত নয়। যদি এ সংক্রান্ত কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়ে থাকে, তবে তা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়ে থাকতে পারে, সেনাবাহিনীকে নয়। সোমবার (১০ মার্চ) তিন বাহিনীর মুখপাত্র আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে এসব তথ্য।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ কঠিন সময় অতিক্রম করছে। পতিত সরকারের প্রত্যাশা মাফিক লাশের সারি দীর্ঘ না করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাঁরা ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালায়নি। সেনাবাহিনী ওই সময় কার্যত তাঁর ’দেশপ্রেমিক’ বিশেষণের সম্মান অক্ষরে অক্ষরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, যা বিশ^পরিমণ্ডলেও আলোচিত-প্রশংসিত হয়েছে। একটি রক্তাক্ত ও সঙ্কটময় পরিস্থিতি শক্ত হাতে মোকাবিলার পাশাপাশি সাহসী মধ্যস্ততায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অপর দু’বাহিনী প্রধান যথাক্রমে- নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনকে সঙ্গে নিয়ে চমৎকার ফয়সালা করেন। একেবারেই অকল্পনীয় এই বিষয়টি ছিল ম্যাজিকের মতোই। সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ৫ আগস্টের আগে-পরের ভূমিকা দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। দেশের ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল এক অধ্যায় হিসেবে। কিন্তু ইউটিউবে-ফেসবুকে এখন সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে ঊণজনের সারিতে, গৌণ ভূমিকায় উপস্থাপনের অপকৌশল চলছে একদিন-প্রতিদিন। সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানকে নিয়ে বিবেকহীন গোষ্ঠীর এমন বিষ ভাব আর জোরেশোরে মিথ্যাচার চলছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু অসাধারণ সাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের মাধ্যমেই মানুষের হৃদয়ের আসনে নিজেদের মূর্ত করে তুলেছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী।

কখনও জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেনি সেনাবাহিনী, দুই জেনারেল যেখানে দৃষ্টান্ত
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মি. ভলকার তুর্ক এর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মানবাধিকারের তাৎপর্য যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে এবং যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে, তবে অধিকতর সঠিকতা ও স্বচ্ছতার উদ্দেশ্যে উক্ত মন্তব্যের কিছু বিষয়ে স্পষ্টিকরণ প্রয়োজন বলে মনে করে।

এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার থেকে এ বিষয়ক কোনো ইঙ্গিত কিংবা বার্তা সম্পর্কে অবগত নয়। যদি এ সংক্রান্ত কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়ে থাকে, তবে তা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়ে থাকতে পারে, সেনাবাহিনীকে নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুযায়ী কাজ করে এবং সর্বদা আইনের শাসন ও মানবাধিকার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে, মি. ভলকার তুর্ক এর মন্তব্য কিছু মহলের মাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, যা সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি এবং এর পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দু’জন সেনাপ্রধান অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একজন জেনারেল নুরুদ্দিন খান ও অন্যজন জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান। ৯০ এর আন্দোলনের সময় তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ সেনাশাসন চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল নুরুদ্দিন সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। জনতার পাশে এসে দাঁড়ান। এরপর চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও আত্মীয়তার সম্পর্ককে প্রাধান্য না দিয়ে পুরোপুরি নিরপেক্ষ থেকে কোন পক্ষপাত এবং বাইরের শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মন-মনন ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে নিজেকে একীভূত করেন। রীতিমতো ইতিহাস রচনা করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ প্রসঙ্গে আইএসপিআর বলেছে, নিরপেক্ষতা ও সততার মহান ঐতিহ্য ধারণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা জনগণের পাশে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষত ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেনি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময়ও সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং কোনো পক্ষপাত বা বাহ্যিক প্রভাব ছাড়াই জননিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

জানা যায়, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে চলেছেন। পেশাদার মনোভাব, অবদান ও আত্মত্যাগের ফলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দ্বিতীয় শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছে বাংলাদেশ। গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য বিভিন্ন সময়ে স্বীকৃতিও মিলেছে জাতিসংঘের। এ প্রসঙ্গে আইএসপিআর বলছে, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এখানে উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অর্জিত আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ শান্তিরক্ষীরা পেয়ে থাকেন এবং এর সিংহভাগ জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যার পরিমাণ গত ২৩ বছরে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা।

আইএসপিআর বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ককে গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করে। দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেনাবাহিনীর ভূমিকা সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে উদ্বেগ অথবা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে তা গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে ফলপ্রসুভাবে সমাধান করা সম্ভব বলেই মনে করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

সম্প্রতি মি. ভলকার তুর্ক’র দেওয়া বক্তব্যেও সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরাও। তাঁরা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পতিত সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলেও সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার পালস বুঝেছিলেন। অগ্নিঝরা জুলাই অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। ছাত্র-জনতার নতুন বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত ছবিটিকে তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেনাপ্রধান ৫ আগস্টের আগেই জনগণের পক্ষে থাকার বিষয়টি পরিস্কার করার পরই আন্দোলন সফলতার দিকে এগিয়ে যায়।এক্ষেত্রে তাঁর সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, দেশপ্রেম, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বড় ভূমিকা রেখেছে। শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ পড়ার বার্তায় তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটি যে অর্বাচীনের প্রবাদ এবং এটি বুঝতে পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই সেটিও পরিস্কার।

কালের আলো/এমএএএমকে