ধর্ষণের শিকার শিশুটির মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন দেশ
প্রকাশিতঃ 10:49 pm | March 13, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
চিকিৎসকদের কোনো চেষ্টাই কাজে এল না; বাঁচানো গেল না মাগুরায় ধর্ষণের শিকার আট বছর বয়সী মেয়েটিকে। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুর ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। এ ঘটনায় শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে মাগুরার জারিয়া গ্রাম থেকে শুরু করে গোটা দেশ। শিশুটির ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ বাবা কিছুই বলতে পরছেন না। বুক চাপড়ে কাঁদছেন ভাইবোনসহ আত্মীয়-স্বজনরা। এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
জানা যায়, মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ৬ মার্চ শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ করে তার পরিবার। সেই খবরে সারা দেশে তৈরি হয় ক্ষোভ। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মিছিল, মানববন্ধনের মত কর্মসূচি চলছে। শিশুটির মা গত ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব হোসেন (১৮) ও বোনের শ্বশুর হিটু মিয়া (৪২), সজীবের অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাই (১৭) এবং তাদের মা জাবেদা বেগম (৪০)। তাদের চারজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মামলার নথিতে বলা হয়, সজীবের সহায়তায় তার বাবা হিটু মিয়া শিশুটিকে ‘ধর্ষণ’ করেন। বিষয়টি জাবেদা ও তার ছোট ছেলেও জানতেন। ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যার চেষ্টা চালান তারা। নির্যাতনের শিকার শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ৬ মার্চই তাকে ঢাকা মেডিকেলের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) ভর্তি করা হয়। পরে শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা শনিবার জানিয়েছিলেন, শিশুটির অবস্থা ‘সংকটাপন্ন’। এরপর তার চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলেও সন্ধ্যায় তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বার্তায় বলা হয়, ‘আজ সে আরও দু’বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়েছে। দ্বিতীয়বার প্রায় ৩০ মিনিট সিপিআর দেওয়ার পর হৃৎস্পন্দন ফিরেছে, তবে তার মস্তিষ্ক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না।’ ‘কোমা স্কেলে (জিসিএস) মাত্রা ৩, যা গভীর অচেতন অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। শিশুটির রক্তচাপ ও অক্সিজেনের মাত্রাও বিপজ্জনকভাবে কম।’’
- জারিয়া গ্রামে শোকের মাতম, জানাজায় মানুষের ঢল
- ধর্ষকের বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতার আগুন
- সবার মুখে মুখে একটাই দাবি, ‘ধর্ষকদের ফাঁসি’, ‘ধর্ষকদের ফাঁসি’
এরপর দুপুরে শিশুটির মৃত্যুর খবর দেয় আইএসপিআর। সেখানে সেনাবাহিনীর তরফে শোক প্রকাশ করা হয়। আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাচানো সম্ভব হয়নি। শিশুটির আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, দুইবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃদস্পন্দন ফিরে আসেনি।’
জারিয়া গ্রামে শোকের মাতম
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) বিকেলে সরেজমিনে মাগুরার শ্রীপুরে জারিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, মৃত্যুর খবর শুনে সবাই ভিড় করছেন শিশুটির বাড়িতে। স্থানীয় সব্দালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পান্না খাতুন বলেন, ‘আমাদের একটাই দাবি, হিটু শেখসহ চার আসামির ফাঁসি।’ একই ইউনিয়নের সদস্য রূপ কুমার বলেন, ‘আমরা শুধু ফাঁসি চাই না। এটা যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়, সেই দাবি সরকারের কাছে রাখছি।’
জারিয়া গ্রামের সবার মুখে মুখে একটাই দাবি, ‘ধর্ষকদের ফাঁসি’, ‘ধর্ষকদের ফাঁসি’। একই সঙ্গে বিচার কার্যক্রম যেন কোনোভাবে বিলম্বিত না হয় সেই দাবিও তাদের। এদিকে, যে বাড়িতে শিশুটি ধর্ষিত হয়েছে সেই বাড়িটি এখন এলাকাবাসীর কাছে ‘ধর্ষক হিটু শেখের’ বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বাড়িটিতে এখন কেউ নেই। বাড়ির মালিক ধর্ষক হিটু শেখ,তার স্ত্রী জাবেদা বেগম, দুই ছেলে সজীব শেখ, রাতুল শেখ সবাই কারাগারে। অন্যদিকে সন্ধ্যার আগে তার মরদেহ নিয়ে সিএমএইচ থেকে হেলিকপ্টারে মাগুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সেনাবাহিনী। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টাটি মাগুরা স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে মেয়েটির মরদেহ শহরের নোমানী ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শিশুটির স্বজনসহ গ্রামবাসীর কান্নার শব্দে ভারি হয়ে উঠে। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) বাদ এশা শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম সোনাইকুন্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সোনাকুন্ডী সম্মিলিত ঈদগা ও গোরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় মানুষের ঢল নামে। চোখের জলে শিশুটিকে চিরবিদায় জানায় এলাকাবাসী। জানাজায় অংশ নেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, মাগুরার জেলা প্রশাসক অহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
ধর্ষকের বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতার আগুন
মাগুরায় ধর্ষণ ও নির্যাতনে মারা যাওয়া আট বছরের শিশুটিকে ধর্ষণে অভিযুক্ত হিটু মিয়ার বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা পেট্রল দিয়ে আগুন দিয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সদর উপজেলার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। তবে ওই পরিবারের অভিযুক্ত চার আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই বাড়িটি তালাবদ্ধ ছিল। মাগুরা ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার ফাইটার রিপন হোসেন বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ট্রিপল নাইনের মাধ্যমে হিটু শেখের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবর পাই। আমরা অগ্নি নির্বাপণে গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেও মাঝপথে গ্রামের মধ্যে বিক্ষুব্ধরা আমাদের গতিরোধ করে। পরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি।
এ বিষয়ে মাগুরা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আইয়ুব আলী বলেন, শিশু ধর্ষণে অভিযুক্ত হিটু শেখের বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর পুলিশ কয়েক দফা সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করলেও বিক্ষুব্ধদের প্রতিরোধের মুখে সেটি সম্ভব হয়নি। তবে গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষের জানমালের যাতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
কালের আলো/এমএএইচএন