আছিয়া যদি আমার মেয়ে হতো
প্রকাশিতঃ 11:35 am | March 14, 2025

মোস্তফা হোসেইন:
মানুষের আবেগ সহমর্মিতাকে পেছনে ফেলে শিশু আছিয়া চলে গেছে ওপারে। মাগুরার এই শিশুটির ওপর পাশবিক নির্যাতনের পর গোটা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। কোটি মানুষের দোয়া এবং সরকারি সর্বোচ্চ চেষ্টার সবই বিফল প্রমাণিত হলো তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর। একজন আছিয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়ে আলোচনায় এসেছে, কিন্তু শুধু আছিয়া একা নয়-সম্প্রতি এমন ঘটনার ব্যাপকতা মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠার জন্ম হয়েছে।
মহামারি করোনার সংক্রমণের মতো যেন ছড়িয়ে পড়ছে ধর্ষণ ও নারীর সম্ভ্রমহানীর ন্যায় অন্যান্য অপরাধ।আতঙ্কটাও করোনার চেয়ে এক তিল পরিমাণ কম নয়।আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রকেট গতিতে।যার মূল ভূমিকা পালন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। সেখানে কিছু রং মিশে যায় জানা-অজানা পথে।অতিরঞ্জন বাদ দিলেও যেটুকু সত্য নিশ্চিত হওয়া যায়, তাকে ভয়াবহ বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। তারপরও বলতে হবে,প্রচারিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি ।
নারীর সম্ভ্রমহানী ঘটলে পরিবার থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়-ঘটনাকে চাপা দিতে। এটা সামাজিক কারণেই হয়ে থাকে। তারপরও পরিস্থিতি ভয়াবহতা বোঝা যায়,পত্রিকার সংবাদের দিকে তাকালে। গণমাধ্যমে যে সংবাদগুলো আসে তার ভিত্তিতেই একটি সংবাদ হয়েছে ১০ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোতে। সেখানে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসেই গড়ে দৈনিক ১২টি করে ধর্ষণের মামলা হয়েছে থানায়।প্রকৃত অবস্থা যে কত ভয়াবহ তা বোঝা যায় সহজেই।
নারীর প্রতি এই আচরণ নতুন নয়। কিন্তু মাত্রাটা বোধ করি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে এই সময়। কেন এই অধপতিত সমাজিচিত্র? অত্যন্ত বেদনাদায়ক এই চিত্র যখন আমাদের ক্ষুব্ধ করে, ঠিক তখনই দেখি আমাদের সন্তানেরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে গেছে। ধর্ষকের বিচার চাইছে তারা,তারা বলছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আজকে রাজপথে মিছিল করছে। তাদের সঙ্গে অনেক শিক্ষকও গলা মিলাচ্ছেন। এইটুকু অন্তত আমাদের আশার আলো দেখাতে পারে।
কেন হচ্ছে এই অবস্থা? মানবিক মূল্যবোধ এর মড়ক লেগেছে নাকি? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় এ নিয়ে। গালি-গালাজ থেকে শুরু করে গুরুগম্ভীর বিশ্লেষণ, হেন কিছু নেই যা ওখানে দেখা যায় না।গুজব গজবের ছড়াছড়ি যেমন আছে আবার উপকারী পরামর্শমূলক বক্তব্যও দেখা যায়।
কেন এই মানবিক অধপতন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায় সবাই নিজের পর্যবেক্ষণগুলোই বলছেন। তারাও আমাদের সন্তানদের মতোই বলছেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। কিন্তু বিচার কোথায়? সনি হত্যা,তনু হত্যা,সাগর- রুনি হত্যার মতো একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে। দু’য়েকটার বিচার হয় বাকি সবই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানোর মতো তামাদি হয়ে যায়। কিন্তু যখন দেখি একটি পাঁচ বছরের শিশুকে নৃশংস-ধর্ষণের কারণে দিনাজপুরের সাইফুল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হওয়ার পরও জামিনে মুক্ত হয়ে সমাজে মিশে যেতে পারে, তখন বিশ্বাস করার কারণ থাকে না ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে আর কাজ হবে। দিনাজপুরের সাইফুল কতটা নৃশংসতার উদাহরণ তৈরি করেছিল একটু ভাবুন। মাত্র ৫ বছরের একটা শিশুকে যৌন নির্যাতন করতে গিয়ে ব্লেড দিয়ে বাচ্চাটার যৌনাঙ্গ কেটে নিয়েছিল। সেই নৃশংসতার তো বিচারও হয়েছিল। আর এই ধর্ষক গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাড়া পেয়ে যায়। আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়- কারণ তখন আমরা অবাক হয়ে দেখছিলাম জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার অপরাধে অভিযুক্ত জঙ্গিও কারামুক্ত হয়ে যায়। প্রথম আলো দিনাজপুরের শিশু নির্যাতনকারীর সংবাদ প্রকাশকালে জানিয়েছে, সাইফুলকে ওই শিশুর পরিবারের সামনেই দিব্যি চলতে ফিরতে দেখা যাচ্ছে। শিশুর পিতা নিজেই এখন নিরাপত্তাহীন এটা বোধ করি বললে ভুল হবে না।
দৈনিক ১২টি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলা যেখানে হওয়ার তথ্য পাওয়া যায় সেখানে প্রমাণের অভাব হয় না কতটা নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন আমরা। ধর্ষণ নারী নির্যাতনকে খাটো করে দেখার একটা প্রবণতা আছে আমাদের। সহজ বাক্যটি ব্যবহার হয়, এটা সামাজিক অবক্ষয়ের ফল। কিন্তু একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, এই প্রবণতার মূল সূত্র হচ্ছে আইনের শাসনের অভাব এবং অপরাধ করার সুষ্ঠু পরিবেশ বিদ্যমান থাকা।অপরাপর অপরাধগুলো যখন সমাজে স্বাভাবিক বিষয় বলে গণ্য হয় তখন দুর্বল হিসেবে নারী ও শিশুরা এর শিকার হতে থাকে। সঙ্গতভাবেই আমরা আইনের শাসন বিষয়ে কথা বলতে পারি, বলতে পারি অপরাধ করার সহজ পরিবেশ বিরাজমান কি না। অপরাধ করার মতো অবারিত সুযোগ আছে কি না এটাও বিবেচ্য হতে পারে।
অভাবনীয় জনপ্রিয় একটি অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে গত জুলাই আগস্টে।এই অভ্যুত্থানে অকল্পনীয় সাফল্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু নতুন নতুন শব্দও জানতে পেরেছে মানুষ। এর একটি হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’। এই ‘মব জাস্টিস’ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে যেমন মাটিতে গুড়িয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে তেমনি সাধারণ মানুষের বিবেককেও প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে। মানুষ দেখেছে এবং এখনও দেখছে-ধর্মীয়,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীদের কিভাবে ‘মব জাস্টিসের’ কবলে পড়তে হচ্ছে। প্রতিটিই বিশ্লেষণযোগ্য। পেশীশক্তির প্রয়োগ হচ্ছে অবলিলায়। পেশীশক্তি যখন সমাজের নিয়ন্ত্রণ সুবিধা পায় তখন এমন অপরাধ বাড়বেই। এটাই স্বাভাবিক। সহনশীলতা এবং আইনের প্রতি অনাস্থা কিংবা অবজ্ঞা যখন সহজ বিষয় হয় তখন অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই। পেশীশক্তি বলে যদি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়, সমাজের অশূর শক্তি সেখানে খড়গ চালাবেই। ছোট একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, দেশের অসংখ্যা মাজার ভেঙ্গেছে ‘মব জাস্টিসের’ নামে।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে শুধু মাজার ভাঙা হয়েছে ৮০টি। সবগুলোর চিত্র একই। যারা মাজার পছন্দ করেন না,যারা মনে করেন মাজার ইসলাম বিরোধী, তারা সংঘবদ্ধ হয়ে সেগুলো গুড়িয়ে দিয়েছে। এবং তা প্রকাশ্যেই। ৮০টি মাজার ভাঙা হলো কোথাও রক্ষার জন্য আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। জানা মতে মব তাণ্ডব যারা চালিয়েছে তাদের কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। তার মানে হচ্ছে- দুর্বল মাজার সেবকরা অসহায় এখানে। পেশীশক্তিওয়ালা মাজার বিরোধীরা এখানে দুর্বলদের পরাস্ত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে।
শুধু মাজার নয়, সংখ্যালঘুদের ওপরও প্রথম ছয় মাসে আক্রমণ হয়েছে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে এবং গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। খুবই সামান্য কিছু দুবৃত্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাকে অনেকেই আইওয়াশ মনে করছে। আসলে সবখানে ভিন্ন মতাবলম্বী এবং দুর্বলদের ওপর পেশীশক্তির দুবৃত্তপনা চলছেই। আইন আছে আইন মানা কিংবা রক্ষার উদ্যোগ নেই।
যারা আইন রক্ষায় নিয়োজিত তারা কি সজাগ আছে? প্রশ্নটা করতে হয়, যখন পুলিশ নিজে থানাতেই আক্রান্ত হয় পেশীশক্তির হাতে। মার খেয়ে গা মুছে তাকে চোখ বুঝে সইতে হয় সবকিছু। এমন পরিস্থিতিতে আইন শৃংখলারক্ষাকারীরা কি পারবে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে? কঠিন সত্য হচ্ছে-তারা পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সমাজের দুর্বল নারী সমাজের নিরাপত্তার ভাবনাটা আসলে কল্পনার মতো। নারীকে ভোগ করা তাকে নির্যাতন করাটাকে দুবৃত্তরা স্বাভাবিক বলে মনে করছে। তারা ভোগ করছে,কারণ তারা জানে আখেরে তাদের কোনো শাস্তি ভোগ করতে হবে না।
নারীর এই অসহায়ত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের বিধি ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। সামাজিক ন্যায় বিচার আইনের শাসন যতদিন ঠুনকো থাকবে ততদিন নারী কেন, সমাজের প্রতিটি দুর্বল অংশকে জুলুমের শিকার হতেই হবে। যদি এ থেকে মুক্তির চিন্তা করে কেউ, তাহলে প্রথমই গোটা আইনশৃংখলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে হবে। না হলে এই মরণব্যাধি আমাদের ছোবল মারবেই।
সবশেষে বলি আছিয়া কথিত সভ্যসমাজকে চপেটাঘাত করে বিদায় নিয়েছে, এই বিদায় যে শেষ নয়। আমার আপনার কন্যা সন্তান আছে,বোন আছে,স্ত্রী আছে তাদের কথা কি ভাবছি আমরা? ভাবা উচিৎ-এই আছিয়া যদি আমার আমাদের মেয়ে হতো,কেমন অনুভূতি হতো এই বিদায়ে? এই বোধ জাগ্রত হোক সবখানে।
লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।