বিতর্ক থাকলেও পর্বতসম চ্যালেঞ্জ নিয়েই ছুটছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
প্রকাশিতঃ 10:37 pm | March 14, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে কঠিন এক সময় পার করছে দেশ। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রীতিমতো টালমাটাল। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে শহর বা গ্রামগঞ্জে এ নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে নানা উদ্যোগের কথা বারবার জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি কিংবা নগরজুড়ে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আলোচনায় এসেছে, সেগুলো ঠেকাতে ব্যাপক অভিযান শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব ঘটনায় নিজেদের দায় এড়াতে পারে না বলছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও। তবে এসব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানা কৌশলের প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবি ওঠেছে। কোথাও কোথাও পালিত হয়েছে কর্মসূচি ও মশাল মিছিল।
উচ্চপদস্থ অভিজ্ঞ সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা তাকে ঘিরে কঠোর সব সমালোচনা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। পাল্টা জবাবের বেলাতেও থেকেছেন বিনয়া বনত ও সতর্ক। বয়সকে হার মানিয়ে ক্ষমতাবান ভাবমূর্তিকে দূরে ঠেলে নির্লোভ, আদর্শ আর সাহসের আলোয় একটি টিম স্পিরিট নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নতি সাধনে মেধা ও পরিশ্রমের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করছেন। শুধু কী তাই? জনরোষের শিকার হয়ে ভঙ্গুর ও নির্লিপ্ত পুলিশ বাহিনীকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে থানায় সেবামুখী করার মতো কঠিন এক চ্যালেঞ্জ পার করেছেন। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে প্রায় শতাধিক তল্লাশিচৌকি বা চেকপোস্ট বসিয়েছেন। বাড়িয়েছেন পুলিশের টহল কার্যক্রমও। অপরাধ প্রবণ এলাকায় টহল জোরদার নিশ্চিত করেছেন। এসব চেকপোস্ট ও টহল দলের রাতের কার্যক্রম কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত দায়িত্ব প্রদান করেছেন। রমজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিজের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা জানিয়েছেন। একেবারেই মনোবল হারানো বাংলাদেশ পুলিশকে স্বগৌরবে ফিরিয়ে আনতে সম্মিলিত প্রয়াসে মনোনিবেশ করেছেন। এসব কাজগুলো এলাম, দেখলাম, জয় করলাম এর মতো সহজ না হলেও ধৈর্য্য, অসীম সাহসিকতা আর পেশাদারিত্বের সঙ্গেই তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে।
জানা যায়, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আন্দোলনের নামে আনসার সদস্যদের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বড় ধরনের অনেক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সজাগ-সতর্ক থেকেছেন-থাকছেন প্রতিনিয়ত। তবুও বিতর্ক তাঁর পিছু না ছাড়লেও অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো স্পর্শকাতর একটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কোন আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেননি সমালোচকরাও। এ থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মান তাঁর নৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ়। দেশের মানুষের প্রতি ও নিজের দায়িত্বের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকেই থেকেই সাহস ও সত্যের ওপর ভর করেই চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হতে তাঁর আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত, এমনটিই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
স্বভাবতই দেশের জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার দায়িত্ব অর্পিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাঁধে। এই পদে দায়িত্ব পালন করা যে কারও জন্য অনেক বেশি চাপের ও চ্যালেঞ্জের। বিশেষ করে যেকোন দেশে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নাজুক আইনশৃঙ্খলা থেকে উত্তরণ ঘটানো সহজ নয় মোটেও। আর এই কঠিন কাজটিই একদিন-প্রতিদিন করে চলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ব্যক্তিজীবনে একজন সরল মানুষ হিসেবেই তিনি পরিচিত। পরিস্থিতির উন্নয়নে নানা পদক্ষেপের ঘোষণাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছেন। প্রথা ভেঙে রাত আড়াইটার দিকেও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকর্মীদের কোন প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যাননি। উল্টো প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তাদের আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন। এক সময় তিনিও সাংবাদিক ছিলেন বলেই কীনা গণমাধ্যমকর্মীদের কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এখনও অবধি কোন বেফাঁস মন্তব্য করে সরকারকে বিপাকে ফেলেননি। ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতায় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে দেশের বর্তমান সময়ের একমাত্র উদ্বেগ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাজের প্রতি আন্তরিকতার একটি বড় প্রমাণ মেলেছে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর আকস্মিক থানা ভিজিট। থানাগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চলছে কীনা এটি পর্যবেক্ষণেই কোন আওয়াজ না দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ছেন। জনগণ যেন নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারেন ও নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেটা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ভোরে রাজধানীর মিরপুর, দারুসসালাম, আদাবর ও মোহাম্মদপুর থানা পরিদর্শনের পর তিনি সোমবার (১০ মার্চ) একইভাবে রাজধানীর তেজগাঁও, ধানমন্ডি, শাহবাগ ও নিউমার্কেট থানা পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে উপদেষ্টা থানাগুলোর অভ্যর্থনা কক্ষ, হাজতখানাসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা ঘুরে দেখেছেন। পথেই তিনি রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্থাপিত কয়েকটি চেকপোস্ট ও তল্লাশিচৌকি পরিদর্শন করছেন। দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথা বলছেন। সরেজমিন পরিদর্শনকালে দায়িত্বে অবহেলায় এক এসআই ও কনস্টেবলকে বরখাস্ত করেছেন। এছাড়া তিনি যৌথবাহিনীর কয়েকটি টহল দলের কার্যক্রমও মনিটরিং করছেন। মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনে আরও তৎপর, সজাগ ও সতর্ক করতেই তিনি সময়োপযোগী এই উদ্যোগ করেছেন। তাঁর এই কর্মতৎপরতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মূলধারার গণমাধ্যমেও প্রশংসিত হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মনে করেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভোরের দিকে দায়িত্বে শিথিলতা দেখান। এই সুযোগে সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করার চেষ্টা করে। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন এ সময়েও সজাগ ও সতর্ক থাকে।’ এই উপদেষ্টা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ‘যারা সংঘবদ্ধভাবে মব পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি করছে, যারা ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’ তিনি বিভিন্ন অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কার্যক্রম রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পর্বতসম চ্যালেঞ্জ নিয়েই প্রতিনিয়ত কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে তাকে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য অনেক চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে হয়েছে, হচ্ছে। বিধ্বস্ত পরিস্থিতি থেকে সবকিছু তিনি গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তাঁর কাজ করার মানসিকতা ও সততা রয়েছে। পদত্যাগের দাবি তুলে তাকে বিব্রত না করে সমর্থন ও স্বত:স্ফূর্ত সহযোগিতার মাধ্যমেই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মানসিকতা ত্যাগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কাজ করছেন। সবাই এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছলে পরিস্থিতি অবশ্যই স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
কালের আলো/এমএএএমকে