নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা নেই বেসরকারি মেডিকেল কলেজে
প্রকাশিতঃ 10:38 am | March 18, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
গাজীপুরের গুশুলিয়া এলাকায় ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ। শুরুতে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই কলেজটি বছরে ১৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে। কলেজটির বাইরের অবস্থা ফিটফাট। কিন্তু ভেতরের অবস্থা বেশ নাজুক। হাসপাতালে রোগী কম থাকে, কলেজ ও হাসপাতালে পরিসর (স্পেস) ঘাটতি আছে, ৩টি লেকচার থিয়েটার ও ৩০টি টিউটোরিয়াল রুমের কমতি আছে, ৬টি বিভাগে ৩৭ জন শিক্ষকের ঘাটতিসহ ইত্যাকার অভিযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি বন্ধ এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩০ থেকে কমিয়ে ৫০ করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু কলেজটি নিয়মিতভাবে শর্ত ভঙ্গ করে চলেছে। আবার শর্ত পুরোপুরি পূরণ না করলেও কলেজটি চালিয়ে যাওয়ার বা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ঘটেছে এমন ঘটনাও।
ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের মতো একই অবস্থা বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজেরই। দেশের ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে গত তিন বছরে দুটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে। এগুলো হলো সাভারের আশুলিয়ায় নাইটিঙ্গেল মেডিকেল কলেজ ও মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিকেল কলেজ। রাজশাহীর শাহ মখদুম, রাজধানীর আইচি ও নর্দার্ন মেডিকেল কলেজ এবং রংপুর নর্দার্ন-চারটি মেডিকেল কলেজকে অবকাঠামো উন্নতিসহ নানা শর্ত দিয়ে ভর্তি স্থগিত রেখেছে সরকার। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ৬৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে।
জানা যায়, অবকাঠামোগত বাধ্যবাধকতা কখনও মানা হয়নি বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে। তাদের রয়েছে শিক্ষকস্বল্পতাও। শিক্ষা কার্যক্রম কোনটির চলে ভাড়া করা ভবনে। অনুসরণ করা হয় না নির্ধারিত শিক্ষাক্রমও। কলেজের হাসপাতাল চলছে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করেই। শিক্ষা উপযোগিতার এসব ঘাটতি পূরণে বারবার তাগাদা দিচ্ছে সরকার। এরপরও পূরণের কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এসব মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। প্রায় সমসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি বছর বেসরকারি এসব মেডিকেল কলেজ থেকে তাদের এমবিবিএস সম্পন্ন করছেন। শিক্ষা কার্যক্রম ও অবকাঠামোর সমস্যা নিয়ে চলছে এসব চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় একটি অংশ। নির্ধারিত শিক্ষাক্রম না মানা ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেরই শিক্ষায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবায় তারা যুক্ত হচ্ছেন মানহীন চিকিৎসক হিসেবে।
দেশের স্বাস্থ্যশিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজই এখন মানহীন চিকিৎসক তৈরি করছে। দেশের জনসাধারণের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা। কোনো কোনো কলেজের অবস্থা এতই নাজুক, সেখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেরাও চিকিৎসক হিসেবে নিজেদের সম্ভাবনা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। শিক্ষাক্রমে ঘাটতির কারণে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পরও চিকিৎসক হিসেবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন পাওয়া নিয়ে সংশয়ে থাকেন তারা।
মেডিকেল কলেজগুলো সীমাবদ্ধতার মধ্যে চললে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক-স্বল্পতার কারণে তাঁরা মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। আবার সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি অভাব ও হাসপাতালে রোগী দেখার সুযোগ না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা হাতে–কলমে শেখার সুযোগ পান না। ফলে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে প্রতিবছর বহু চিকিৎসক বেসরকারি মেডিকেল থেকে বের হচ্ছেন। অনেকে মনে করেন, চিকিৎসক ও চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে অসন্তোষ ও অভিযোগ, তার একটি কারণ বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অপূর্ণতা, অব্যবস্থাপনা।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হোসেন একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারি বা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ খুব কম আছে, যারা আদর্শ অবস্থায় চলছে। কিছু মেডিকেল কলেজের দুর্বলতা সামান্য, কিছু কলেজের মারাত্মক। আমাদের কাজ মেডিকেল শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া, মান উন্নত করা, মান বজায় রাখা, মেডিকেল কলেজ বন্ধ করা নয়।’
কালের আলো/এমএসএএকে/আরআই