ভারতীয় মিডিয়ার সুরে তুলসী গ্যাবার্ডের বিতর্কিত বক্তব্যে নিন্দা, ক্ষোভ ও সমালোচনার ঝড়
প্রকাশিতঃ 11:12 pm | March 18, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার শুরু করে ভারতীয় গণমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ দেশটির বেশকিছু গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর ও ‘আতঙ্ক ছড়ানো’ বিভিন্ন ভিডিও, ছবি ও সংবাদ প্রকাশ পায়। বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ারও কসরত চলে দেদারছে। কিন্তু প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ চূলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি ঘটনার সঙ্গেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোন কোন সম্পর্ক নেই। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর হামলা ধর্মীয়ভাবে নয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। এর প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ পুলিশের অনুসন্ধানেও। গত বছরের ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত এসব হামলা ও ভাঙচুরের ১ হাজার ৪১৫টি অভিযোগের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৪ শতাংশই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রদায়িক কারণে। প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এবার ভারত সফরে গিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের সুরেই কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডও।
তিনি সোমবার (১৭ মার্চ) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন। ইসলামিক খেলাফত নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দুর্ভাগ্যজনক নিপীড়ন, হত্যা এবং নির্যাতন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়।’ তাঁর বিতর্কিত এসব মন্তব্যের জেরে দেশজুড়ে ঝড় ওঠেছে সমালোচনার। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও। নিন্দা জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। দেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে নানামুখী অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই তুলসী গ্যাবার্ড এর বিভ্রান্তিকর এমন মন্তব্য দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য নতুন করে হুমকি তৈরির ‘ফাঁদ’ হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধানের মন্তব্য প্রমাণ করে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির যে পাঠ নিচ্ছেন তা ভারতীয় প্রোপাগাণ্ডা নির্ভর এবং সত্যের অপলাপ। এটি অবশ্যই দুরভিসন্ধিমূলক, আধিপত্যবাদী ও পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রেরই বহি:প্রকাশ।’
- তাঁর এই বক্তব্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনামের জন্য ক্ষতিকর
- পতিত সরকারের সময়েও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন তিনি
- বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
- ইসলামিক খিলাফত ধারণার সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান বাংলাদেশ সরকারের
- অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণেই গ্যাবার্ড’র মন্তব্য, বলছেন সাবেক কূটনীতিকরা
- নাগপুরে হিন্দু-মুসলমান সহিংসতায় সংখ্যালঘুদের তথাকথিত রক্ষক ভারতের আসল স্বরূপ উন্মোচিত
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডে স্বল্প অভিজ্ঞতা থাকা তুলসী গ্যাবার্ড এমন সময়ে এই মন্তব্য করেছেন যখন খোদ ভারতের মহারাষ্ট্রের নাগপুরে গত কয়েকদিন ধরে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা চলছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই মুসলিমদের এই সংঘাতের জন্য দায়ী করতে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। এর মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের তথাকথিত রক্ষক ভারতের আসল স্বরূপ আরও একবার উন্মোচিত হলেও তুলসী গ্যাবার্ড এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।’ এদিকে, সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান মাসেও ভারতের মুসলমানদেরকে হত্যা-নির্যাতন ও মসজিদে হামলাকারী হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদেরকে কঠোরভাবে দমন করতে ভারত সরকারকে চাপ দিতে দু’দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানায় বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ।
হিন্দুদের ওপর হামলা ধর্মীয় নয় রাজনৈতিক
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ড.ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সব ধর্মীয়, জাতিগত ও সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধান ও আইন সংখ্যালঘুদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে। বর্তমান সরকার ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ-নির্বিশেষে দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। তুলসী গ্যাবার্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত বক্তব্যে ক্ষোভ-অসন্তোষের মধ্যেই মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন মার্কিন সিনেটর গ্যারি পিটার্স (ডি-এমআই)। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তাকে বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি নাগরিকের বর্ণ, ধর্ম, জাতি এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে মানবাধিকার রক্ষায় তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গত বছরের আগস্টে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে তা ধর্মীয়ভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। তবে তার সরকার দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে।’ ড. ইউনূস মার্কিন সিনেটরকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও শহর পরিদর্শন করার আহ্বান জানান। তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রকৃত তথ্য জানতে দেশটি সফর করার জন্য অন্যান্য মার্কিন রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং কর্মীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
পতিত শেখ হাসিনার সরকারের সময়েই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন তুলসী গ্যাবার্ড
এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন তুলসী গ্যাবার্ড। পরে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন। ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তুলসীকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে মনোনীত করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৪৩ বছর বয়সী তুলসীর মনোনয়ন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়। তাঁর ব্যাপারে খোদ রিপাবলিকান পার্টির অনেকে আপত্তি জানান। তাঁকে নিয়ে উদ্বেগ জানান যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রায় ১০০ কূটনীতিক, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন ট্রাম্প।
মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম এই হিন্দু সদস্য পতিত শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এনে মার্কিন কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব আনেন ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই। তখন তিনি ছিলেন কংগ্রেস সদস্য। ওই প্রস্তাবনার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আহ্বান’। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সময়কার পুরনো রেজুলেশনটি নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার শুরু হয়। প্রোপাগাণ্ডার দিকে চোখ রাখলে মনে হতে পারে তুলসীর এই অভিযোগটি যেন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আনা হয়েছে। অথচ এই প্রস্তাবটিই আনা হয়েছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের জামানায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলেছিলেন। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে প্রচুর ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস রয়েছে, তারা দেখবে বাংলাদেশে কী ঘটছে বা সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আদৌ ঘটেছে কি না।’ এদিকে, তুলসী গ্যাবার্ডের সাম্প্রতিক মন্তব্যের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় সোমবার (১৭ মার্চ) এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস। তিনি বিষয়গুলোকে কূটনৈতিক আলোচনার বিষয় উল্লেখ করে আগাম কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
বাংলাদেশের মানুষ খুবই ধর্মপরায়ণ। তবে তাঁরা ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণু, বন্ধুবৎসল ও অসাম্প্রদায়িক। তাঁরা নিজেরা ধর্মভীরু হলেও অন্য ধর্মের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। ধর্ম বা বোধ-বিশ্বাস নিয়ে এখানে কোন বিভাজন নেই। সবাই নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার ভোগ করছেন। এক সময় ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে বিরোধীদের বিরুদ্ধে অবলীলায় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতার পরিকল্পিত ও বায়বীয় অভিযোগ তুলেছে পতিত সরকার। একইভাবে এখন চিহ্নিত ওই মহলটি পুনরায় ক্ষমতা পেতে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে অনুসঙ্গ বানানোর পাঁয়তারা করছে। সংখ্যালঘুদের জীবন, সংস্কৃতি, নিরাপত্তা সুরক্ষার সঙ্গে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সম্পর্ক থাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস বারবার জানিয়ে দিয়েছেন, সব ধর্ম-মতবাদের মানুষের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা, মর্যাদা ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার বিষয়টিকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
- হিন্দুদের ওপর হামলা ধর্মীয় নয় রাজনৈতিক
অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস
প্রধান উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকার
একই সঙ্গে বিশ্বপরিমণ্ডলে দেখানো হচ্ছে-বাংলাদেশে ইসলামপন্থী খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে। মূলত নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতেই একটি চক্র এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক তৎপরতা একই আদর্শ ও লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই আদর্শ ও লক্ষ্য হলো ইসলামপন্থী খিলাফতের মাধ্যমে শাসন করা।’ কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যও মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ও কাল্পনিক। সর্বৈব মিথ্যা ও বাস্তবতা বিবর্জিত আষাঢ়ে গল্পের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর এক অপকৌশল তিনি গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে এনডিটিভি হিন্দু ধর্মেও তুলসী গ্যাবার্ডের ধর্মীয় ভাবাবেগকেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টা করেছে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তুলসী গ্যাবার্ডের বিভ্রান্তিকর মন্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া প্রতিবাদ, দেশকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপনের অপপ্রয়াস
তুলসী গ্যাবার্ডের বিভ্রান্তিকর সব মন্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, এই বক্তব্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনামের জন্য ক্ষতিকর। বিবৃতি বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলাম চর্চার জন্য সুপরিচিত এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। গ্যাবার্ডের মন্তব্য কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ বা অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি। বক্তব্যে পুরো বাংলাদেশকে অন্যায় ও অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো বিবৃতিতে সরকার বলেছে, বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও চরমপন্থার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তবে এটি ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক সংস্কার এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে। বাংলাদেশকে ভিত্তিহীনভাবে ইসলামিক খিলাফতের সঙ্গে যুক্ত করার অর্থ হলো বাংলাদেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের কঠোর পরিশ্রমকে খাটো করে দেখা, যারা শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইসলামিক খিলাফত ধারণার সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টাকে বাংলাদেশ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উচিত সংবেদনশীল বিষয়ে মন্তব্য করার আগে সে বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখা এবং ক্ষতিকর গৎবাঁধা ধারণা ও ভীতি ছড়ানো বা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দেয়ার মতো কোনো কিছু বলা থেকে বিরত থাকা। সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে যৌথ বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে বাংলাদেশ সমর্থন করে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাস্তব তথ্য ও সকল দেশের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে গঠনমূলক সংলাপ অংশগ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণেই গ্যাবার্ড’র মন্তব্য, বলছেন সাবেক কূটনীতিকরা
অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির। তিনি একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে যথাযথভাবে হয়তো অবহিত নন সে কারণে তিনি এ মন্তব্যটা করেছেন। কাজেই তাকে যদি আমরা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাটা জানাতে পারি তাহলে আমি মনে করি তিনি যেটা মনে করছেন সেটা হয়তো তার পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে।’
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের উত্থানে গ্যাবার্ডের মন্তব্য দেশটির অতীতের রেকর্ডকে অনুসরণ করে না বলে জানান এই সাবেক কূটনীতিক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে বাংলাদেশে যেভাবে জঙ্গি কর্মকাণ্ড, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান তৈরি করেছে, তথ্যউপাত্তের সাথে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্য যে মেলে না, সেটা জোরালোভাবে তুলে ধরা উচিত। তাঁর এই বক্তব্য তো আর একটা নীতি হয় না, একটা বক্তব্য একটা অবস্থান হতে পারে। কাজেই সেই অবস্থানটা যে বাস্তব ও বস্তুনিষ্ঠ নয়, সেটা আমাদের তুলে ধরতে হবে।’
একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এটা নিয়ে একটা অ্যাটেনশন দিয়েছে, ফলে তার কী এভিডেন্স আছে সেটাও দেখা দরকার। ফলে বাংলাদেশের সরকারকেই এখন দৃশ্যত তুলে ধরতে হবে যে, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তারা ভয়-ভীতির মধ্যে নেই।’
‘গুরুতর’ দেখছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, সজাগ থাকার দাবি ধর্ম উপদেষ্টার
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং ইসলামিক খিলাফতকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড যে মন্তব্য করেছেন, সেটি গুরুতর বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এ কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যে প্রতিক্রিয়া (তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যের) জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থানও তাই। ওনার (তুলসী গ্যাবার্ড) বক্তব্য গুরুতর।’
একই দিনে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। একই বিষয়ে কথা বলেছেন ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনও। তিনি বলেছেন, ‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকলেও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বিদেশিরা যেভাবে বলছেন সেই মাত্রায় নেই। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো আছেই, তারপরও আমরা অত্যন্ত সজাগ রয়েছি। কিছু কিছু মাজারেও হামলার ঘটনা ঘটছে, ভাঙচুর হচ্ছে। আমরা অত্যন্ত সিরিয়াস এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসি গ্যাবার্ড বাংলাদেশ সম্পর্কে একগুচ্ছ মিথ্যা ও দুরভিসন্ধিমূলক বক্তব্য দিয়ে ভারতকে খুশি করার অপচেষ্টা করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। অন্যদিকে, মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) দুপুর ১২টায় গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ও সহ-সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি, ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ‘গভীর উদ্বিগ্ন’ বলে দিল্লিতে একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন মার্কিন ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্সের প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড। আমরা এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই। বাংলাদেশে কোনও ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ নেই, সংখ্যালঘুদের ওপরও অনাকাঙ্ক্ষিত কোনও ঘটনা ঘটেনি। বরং ইতোপূর্বে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে।’
কালের আলো/এমএএএমকে