ইতিকাফ রমজানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ

প্রকাশিতঃ 12:13 pm | March 20, 2025

ধর্ম ডেস্ক, কালের আলো:

ইতিকাফ হল একটি ইসলামী রীতি যার মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন মসজিদে অবস্থান করা, এই দিনগুলিতে নিজেকে ইবাদতে নিয়োজিত করা এবং পার্থিব বিষয় থেকে দূরে থাকা। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো, নিয়মিতভাবে কোন কিছুতে লেগে থাকা বা নিয়মিত থাকা। রমজানের শেষ ১০ দিনে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে এটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় , যে সময়টিতে কেউ মসজিদের একটি অংশে নিজেকে আলাদা করে রাখে এবং তার সমস্ত সময় ইবাদতে ব্যয় করে।

নির্দিষ্ট কিছু শর্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইবাদত বন্দেগি করার উদ্দেশ্যে জামে মাসজিদে অবস্থান করা। ইতিকাফ পূর্ণ রমজান মাস জুড়ে ও হতে পারে যা হাদিস দ্বারা প্রমানিত। আবার রমজান মাস ছাড়াও হতে পারে।

ইতিকাফ তিন প্রকার:
১. সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়াহ: যা একমাত্র রমজান মাসে লাইলাতুলকদর পাওয়ার জন্য রমজানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে থেকে সুন্নাত ইতিকাফ আরম্ভ হয়। আর যে দিন ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা যায় সে দিন শেষ হয়। যদি সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে চাঁদ দেখা যায়, তাহলে সূর্যাস্ত হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফে অবস্থান করা আবশ্যক। (সূত্র : ফাতাওয়ায়ে শামি ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১৭৯, বুখারী :২০২৫, মুসলিম :১১৭২)

২. ওয়াজিব ইতিকাফ: তা হলো মান্নত ই’তিকাফ। অর্থাৎ যে কয়দিন মান্নত করবে সে কয়দিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব।( সূরা হজ্ব : ২৯)

৩.নফল ইতেকাফ: মান্নত ও রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ ব্যতীত অন্য সময়ের ইতিকাফ নফল পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এই ইতিকাফে সময়ের ব্যাপারে কোন সীমাবদ্ধতা নেই। দিনে/রাতে যে কোন সময় করা যায়।

ইতিকাফের গুরুত্ব: ইসলামে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,’আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আ.) কে নির্দেশ দিলাম যে, আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও ইতিকাফকারীদের জন্য পবিত্র কর। ( সুরা বাকারা- ১২৫ )

অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,

তোমরা স্ত্রীদের সাথে মেলা-মেশা করো না যখন তোমরা মসজিদে ইতিকাফ কর। (সুরা বাকারা – ১৮৭)।

লাইলাতুল কদর তালাশ করার ক্ষেত্রে ইতিকাফ এর বিকল্প নেই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর রমজান মাসে ইতিকাফ করতেন। অন্তরকে একমাত্র আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করার জন্য ইতিকাফ এক চমৎকার প্রশিক্ষণ। যা সুন্নাতসম্মত পন্থায় দুনিয়া বিরাগী হওয়া।

আর উম্মতের জন্য রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। যদি কোন মহল্লা থেকে একজন ব্যক্তি আদায় করে তাহলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু যদি মহল্লার কেউ আদায় না করে তাহলে সকলেই গুনাহগার হবে।

একাধিক হাদিসে এসেছে, হজররত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ কর। ( বুখারি: ১০৭২)।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। ( বুখারি: ১৯৮০,১৯৮১)।

অন্য হাদিসে এসেছে,

হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রমযানের শেষ দশক শুরু হওয়ার সাথে সাথে রসুল (সা.) সারারাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তিনি নিজেও ইবাদতের জোড় প্রস্তুতি নিতেন। ( সহিহ মুসলিম, বাবুল ইতিকাফ)।

হজরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করতেন। অতঃপর যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন। ( বুখারি: ১৯৯৭)।

ইতিকাফের ফজিলত:

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, বাবুস সাওম)।

রসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করবে তার জন্য দুইটি হজ্জ ও দুইটি ওমরার সওয়াব লেখা হবে। ( বায়হাকি:৩৬৮০)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুল সা. থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক সমান দুরত্ব সৃষ্টি করবেন, যা আসমান জমিনের দুরত্ব অপেক্ষা বেশি। (তবারানি)।

উপরন্তু ইতিকাফকারী যদি রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রগুলোতে ইবাদত করে তাহলে অবশ্যই সে লাইতুল কদরের ফজিলত লাভ করবে। আর কদর রাতের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন -কদরের রাত্র হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ( সুরা ক্বদর – ০৩) এছাড়াও ইতিকাফের মাধ্যমে ব্যক্তি সহজেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে।

ইতিকাফের শর্তসমূহ
১. ইতিকাফের নিয়ত করা ।
২. রোজাদার হওয়া।
৩. জামাত হয় এমন মসজিদ হওয়া।
৪. মুসলমান হওয়া।
৫. আকেল ও জ্ঞানবান হওয়া।
৬. জানাবাত ও হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্র থাকা।
৭. মহিলা তার ঘরে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করা।
৮. মহিলা ইতিকাফ অবস্থায় ঘর থেকে বের না হওয়া।
৯. মহিলাদের জন্য স্বামীর অনুমতি নেওয়া।
১০. ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত কিন্তু নফল ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত নয়।
১১. পাগল না হওয়া।
( সূত্র: ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )।

ইতিকাফ ভঙ্গের কারণসমূহ:-

১. ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস করা। ২. শরয়ি ও মানবীয় প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া। শরয়ি প্রয়োজন হলো: জুমার নামাজ, ফরজ গোসল ইত্যাদি। আর মানবীয় প্রয়োজন হলো : প্রস্রাব, পায়খানা ইত্যাদি। (ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতে, এই সকল কাজ ছাড়া মসজিদের বাহিরে গেলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। হোক সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত।)
৩. ইতিকাফ অবস্থায় জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করা ।
৪. ইতিকাফ অবস্থায় রুগী দেখতে যাওয়া।
৫. যে সকল কাজ মসজিদে করা সম্ভব, ঐ সকল কাজ করার জন্য মসজিদ হতে বের হওয়া। যেমন, ঘুম, খাওয়া।
৬. ইতিকাফ অবস্থায় পাগল বা বেহুশ হয়ে যাওয়া।
৭. ইতিকাফ অবস্থায় কোন মহিলার মাসিক শুরু হলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
( সূত্র: হেদায়া, ফাতাওয়ায়ে শামি, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )।

ইতিকাফে করনীয়:
ক. বেশি বেশি কুরআন ও হাদিস পাঠ করা।
খ. সিরাতুন্নবী সা. অধ্যয়ন করা।
গ. আম্বিয়া আ.গণের জীবনী পাঠ করা।
ঘ. ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া।
ঙ. গুনাহ হয় এমন কাজ না করা।
চ. সালিহীনদের কিতাবাদি পাঠ করা।
ছ. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা।
জ. শরয়ি আহকামের কিতাবাদি পাঠ ও রচনা করা।
ঝ. প্রয়োজন ছাড়া মুবাহ কথা না বলা। ইত্যাদি।
( সূত্র: ফাতাওয়া ও মাসায়েল ই.ফা. ১ম খন্ড)

ইতিকাফে বর্জনীয়:

ক. ব্যবসার উদ্দেশ্যে মসজিদে ক্রয় বিক্রয় করা মাকরূহ।
খ. ক্রয় বিক্রয়ের বস্তু মসজিদে উপস্থিত করা মাকরূহ।
গ. ইতিকাফ অবস্থায় কথা না বলাকে ইবাদত মনে করা মাকরূহ। তবে গুনাহ হয় এমন কথা পরিহার করা ওয়াজিব।
ঘ. ই’তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা, স্পর্শ ও আলিঙ্গন করা বা সঙ্গম করা হারাম।
( সূত্র: ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )।
মোটকথা; রমজানের অন্যতম একটি অংশ ইতিকাফ, যেখানে রয়েছে শবে কদর ও কুরআন মাজীদ নাজিলের সম্পর্ক, যার জন্য দামী হচ্ছে রমজান মাস। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমরা তখন ঈদের মার্কেটে কিংবা হাঁটে বাজারে দুনিয়াবি কাজে বেশি সময় নষ্ট করি। রমজানের যত শেষ ঘনিয়ে আসে, আমরা তত বেশি মাসজিদ থেকে দুরে সরি। আমল ছেড়ে দেই, যা কখনো কাম্য নয়।

অতএব শেষ দশকে তাওবাহ, ইস্তেগফার, দরুদপাঠ, কুরআন তেলওয়াত, হাদিস শিক্ষা, তাহাজ্জুদ সহ বেশি বেশি নফল এবাদত বন্দেগি করা প্রতিটি মুসলমানদের জন্য কর্তব্য। আল্লাহপাক আমাদের রমজানের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করার তৌফিক দান করুক, আমিন।

কালের আলো/এএএন