কার ফাঁদে হাসনাত? কেন বিলম্বিত উপলব্ধি?

প্রকাশিতঃ 6:40 pm | March 22, 2025

মোস্তফা কামাল:

বড় সঙ্গিন সময়ে ছক্কা হাকাতে গিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহর ওভার বাউন্ডারি নয়, ওভার স্টেডিয়াম হওয়ার অবস্থা। চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসনাত নামেই যথেষ্ট পরিচয়ের তারকা সমন্বয়ক তিনি। মাঝেমাঝে স্ট্যান্ট বা ক্রেইজ তৈরিতে সফলতার দৌড়ে এ ম্যাজিশিয়ান একটা বাজে সময়ে ছক্কা হাকাতে গেলেন। তা করতে গিয়ে গোটা সেনাবাহিনীকে নিয়ে বোমা ফাটিয়ে বসলেন। অবশ্য বোমাটা ফেটেও ফাটেনি। দ্রুত সময়ের মধ্যে একদিনের ব্যবধানে কথা সংশোধন করে হাসনাত শনিবার বলেছেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের কোনো অবস্থা নেই। বরং পূর্ণ আস্থা ও শ্রদ্ধা রয়েছে।

গুজবের বাজার গরম করে, কন্টেন্ট বেপারিদের ব্যবসা জমিয়ে পরিস্থিতিতে কাউর বাধিয়ে এখন কেন এ বোধ? হাসনাতের বোধটা জেগেছে একটু দেরিতে, পানি আচ্ছা মতো ঘোলা করে। অথচ মাত্র ক’দিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উ-জামান অত্যন্ত লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ারে বলেছেন, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বন্ধ করতে। নইলে সামনে বিপদ আছে। ঘটনা, সময় এবং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় গুরুত্ব পেয়েছে তার রাওয়া ক্লাবে দেওয়া সেই বক্তব্য। যা আজকের সময়ের সঙ্গেও প্রাসঙ্গিক।

সেখানে তিনি সবাইকে সতর্ক-সাবধান, হুমকি-হুঁশিয়ারি যে ভাষাতেই হোক সময়োচিত দশ কথার কয়েকটি বলতে ছাড়েননি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছেন। নির্বাচনের কথাও বলেছেন। নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই তাও জানিয়েছেন। তার বক্তব্যের সেই থিম সময়ের ব্যবধানে শুক্রবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কণ্ঠে। মির্জা ফখরুল বলেছেন, দেশ বড় কঠিন সময় পার করছে। আর জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন- এ সময়ে সংযত, সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি।

এমন জরুরি আহ্বান ও সতর্কতা বোধ হয় স্পর্শ করেনি হাসনাতসহ তার কোনো কোনো সহযোদ্ধাকে। নইলে কীভাবে- কেন সেই ১১ মার্চের বাসী বিষয় টেনে এনে সেদিন জানালেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে রিফাইন্ড করার আয়োজন চলছে? বৈঠক করে এতে সহায়তা করতে বলা হয়েছে ছাত্র নেতাদের। জবাবে হাসনাত সাহস ও বীরত্বের সাথে কীসব বলেছেন, এর একটা ফিরিস্তি দিলেন ফেসবুক পোস্টে। পুরো বর্ণনাতেই একতরফা থ্রিল-ড্রামা। রাজনীতি ও সমসাময়িক পরিস্থিতির মাঝে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে টোকা দেয়ার ষোলআনা কাজই তিনি করলেন। পেলেন ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কেবল একতরফা-একপক্ষীয় অভিযোগ তুলেই তারা ক্ষ্যান্ত দেননি, মব ডেকে এট্টোসিটি করারও চেষ্টা করেছে। তার বক্তব্যের উল্টো পিঠে কী আছে- সেটাও জনগণের জানা দরকার। হাসনাতদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের আদৌ কিছু ঘটেছে কী না, ঘটলে কী ঘটেছে- তার একটা ব্যাখ্যা আসা দরকার।

একপক্ষের বক্তব্য শুনে কোনো উপসংহারে আসা ঠিক নয়। সেনাবাহিনী এবং বাহিনীর প্রধানকে মিন করে কিছু বললে কাভারেজ তো আপনাআপনিই চলে আসে। কিন্তু, সেনাবাহিনী তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, না তিনিই গিয়েছিলেন? সাংবাদিকরা বারবার এ প্রশ্ন করেও জবাব পাননি। হাসনাত বলেছেন, তার পোস্টে তা উল্লেখ আছে। তন্ন- তন্ন করে বার কয়েক পড়েও তার পোস্টে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

প্রায় একই সময়ে ভাইরাল হয়েছে উপদেষ্টা আসিফের একটি ভিডিও স্ট্যাটাস। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, কীভাবে ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বাছাই করা হয়। সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার কী বলে এ নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন। এ বর্ণনাও একেবারে একতরফা। তারওপর তিনি একজন উপদেষ্টা। বর্ণনা ঠিক থাকলেও তিনি তা প্রকাশ করতে পারেন না। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য গোপন রাখবেন বলে তিনি শপথবদ্ধ। উল্লেখ্য মন্ত্রীদের মতো উপদেষ্টারাও পর পর দুটি শপথ নেন। প্রথমটি নিযুক্তির শপথ। দ্বিতীয়টি রাষ্ট্রীয় তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার শপথ। ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া সেই শপথটি ভঙ্গ করলেন।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই- প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দেওয়া এ বক্তব্য ঘিরে একটি উত্তাপ তৈরির আয়োজন চলছিল ক’দিন ধরেই। এর মাঝেই আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে—এমন আশঙ্কা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকেও জড়িয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের বক্তব্য। সময়টা বড় স্পর্শকাতর। চলছে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ।

জাতীয় সংসদ, গণপরিষদ, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন—কোনটি আগে হবে, তা নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ পুরোনো দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতভেদ আছে। আর তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির মূল চাওয়া গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য আগে গণপরিষদ নির্বাচন অথবা একই সঙ্গে গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোট দেয়ার বয়স ১৬ বছর এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ২৩ বছর করার প্রস্তাব করবে তারা। এনসিপির উপলব্ধি গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান আর কার্যকর নেই, তাই নতুন করে সংবিধান রচনার দাবি দলটির।

এসব বোধ-দাবি রাজনৈতিক বিষয়। চেতনাগত বিষয়ও। আর রাজনৈতিক বিষয়ের রাজনৈতিক ফয়সালা আসবেই। অপেক্ষা শুধু সময়ের। সেইসঙ্গে পরিস্থিতি বা নমুনা দৃষ্টে সাবধানতার কিছু বিষয়াদি রয়েছে। স্থানিক- আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা বিবেচনায় এখন মাথা ঠান্ডা রাখার সময়। যে কোনো পক্ষের হঠকারী যে কোনো পদক্ষেপ মহা সর্বনাশ করে দিতে পারে। সেই বুঝ রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে অবশ্যই রয়েছে। তাদের কারোই না বোঝার কথা নয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর জনআস্থায় ছিঁড় ধরাতে পারলে কার লাভ হবে?

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনী জনগণের পাশে না দাঁড়ালে দেশের কী অবস্থা হতো? গণঅভ্যুত্থানের পরে এখন কেন সেই বাহিনীটিকে বিরোধে টেনে আনা? সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে অরাজক পরিস্থিতির মুখে দেশকে ঠেলে দেয়া প্রকারান্তরে আরেক ফ্যাসিজম। ঢালাওভাবে সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে বিষোদ্গার বিশেষ কারো কারো মধ্যে পুলক জাগাচ্ছে।

এ ছাড়া, এখন পর্যন্ত কথিত রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ বলতে কিছু দৃশ্যমান নেই। শোরগোল পুরোটাই একমুখী-একতরফা-একরোখা। রাজনীতিতে আবার ফিরতে আওয়ামী লীগ নিজে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে- এমন গ্রহণযোগ্য তথ্য নেই। সূত্রও নেই। হাসনাতের মাধ্যমে যেটুকু আলোচনায় এসেছে, সেটি তথ্য না ফাঁদ? –তাও অস্পষ্ট।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।