পদের প্রভাবে আইনকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন তুরিন 

প্রকাশিতঃ 6:08 pm | April 10, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

আলোচিত থেকে হয়েছেন চরম বিতর্কিত। একসময় ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) দাপুটে প্রসিকিউটর। ২০১০ সালে গঠিত এই ট্রাইব্যুনালে তিনি প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পান ২০১৩ সালে। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আলোচনায় আসেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে নিজের মাকে কারাগারে পর্যন্ত পাঠিয়েছেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। মূলত পদের প্রভাবে বারবার আইনকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন তিনি। নিজের স্বার্থের বাইরে গেলে দেখাতেন মামলা-মোকদ্দমার ভয়। টাকা কামাতে প্রথিতযশা ব্যক্তিদেরও করতেন ব্ল্যাকমেইল।

কিন্তু এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। গত ৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। মঙ্গলবার তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইনের আদালত।

জানা যায়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম হাতিয়ার ছিলেন তুরিন। সেই সুবাদে ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পান তিনি। আর দায়িত্ব নিয়েই জড়িয়ে পড়েন একাধিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে থাকলেও অর্থের কাছে হার মানেন এই ব্যারিস্টার। কয়েক কোটি টাকার লোভে গোপনেই দেখা করেন যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে।

ওয়াহিদুল ছিলেন এনএসআই ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তার বিরুদ্ধে হওয়া একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে তুরিনের কাঁধে। অনৈতিকভাবে ওয়াহিদুলের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগে ২০১৮ সালের মে মাসে তুরিনকে অব্যাহতি দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে। ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদটিও খোয়ান তিনি। মূলত নানান অপকর্মের কারণেই তাকে অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। অথচ গ্রেফতারের পর ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলেই চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন’ বলে আদালতকে জানান ‘ধূর্ত’ এই আইনজীবী।

আইনজীবী মনোয়ার পাটোয়ারী বলেন, ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ওয়াহিদুল হকের মোবাইলে যোগাযোগ করেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে বলে দেখা করতে চেয়েছেন তিনি। তবে দেখা না করলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির হুমকি দেন তিনি। ওই সাক্ষাতে ঘুষের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তুরিন। তার এমন আচরণ একেবারেই অপেশাদার ছিল। মূলত মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ওয়াহিদুলকে বাঁচাতে চেয়েছেন তিনি। এক কথায় টাকার জন্য যেকোনো কাজই করতেন তুরিন।

এরপর হঠাৎই সামনে আসে তার পারিবারিক কেলেঙ্কারি। মিথ্যা মামলা দিয়ে নিজের মাকে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে এ আইনজীবীর বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে জন্মদাতা মাকে বাড়ি থেকেও বের করে দেন তিনি। এমনকি নিজের মাকে হেনস্তা ও নির্যাতনের অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের কাছে তুরিনের বিরুদ্ধে হেনস্তা ও নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন তার মা সামসুন নাহার তসলিম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, উত্তরায় আমার নিজের বাড়িতে আমি থাকতে পারছি না। আমাকে বের করে দিয়েছে। আমি এ বাড়ি ও বাড়ি, ভয়ে ভয়ে থাকি। যেখানেই থাকি সে (তুরিন) খবর পেলেই সেখানে লোকজন পাঠায়।

ওইদিন সামসুন নাহার তসলিম আরও বলেন, ও আগে ভালোই ছিল। কিন্তু আমার বাবা (তুরিনের নানা) মারা যাওয়ার পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। থানা পুলিশের ভয় দেখায়, আমি তো একা থাকি, আমি বাধ্য হয়েছি এখান থেকে চলে যেতে। শুধু এখানেই নয়, নীলফামারীতে আমার গ্রামের বাড়ি, সেখানেও আমাকে নিষিদ্ধ করেছে। আমি যেন এলাকায় যেতে না পারি সে সন্ত্রাসীর ভয় দেখায়। আমাকে জামায়াতের রোকন বানিয়ে লিফলেট বিতরণ করেছে। অথচ জামায়াতের সঙ্গে কোনোদিন আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ওই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।

তখনকার সময়ে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরীসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করে আলোচনায় চলে আসেন এ আইনজীবী। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রভাবশালী দুই আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগ ছিল তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে। এরপরই ট্রাইব্যুনাল থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে অনৈতিকভাবে আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠক করার অভিযোগ তদন্তের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনও করা হয়। ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ। তবে দল তাতে সাড়া দেয়নি।

ইসলামপন্থি রাজনীতিতে অর্থায়ন ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ এনে ১১৬ জন ধর্মীয় বক্তার একটি তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত গণকমিশন।

২০২২ সালের ১১ মে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার হাতে এ তালিকা তুলে দেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণকমিশনের চেয়ারম্যান ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (বর্তমানে কারাবন্দি)। সঙ্গে ছিলেন সংগঠনটির সদস্যসচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। এতে এক হাজার মাদরাসা ও ১১৬ জন ধর্মব্যবসায়ী বা ওয়াজকারী সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়। যা সেসময় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।

কালের আলো/এমএএইচএন