প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও ম্যানেজ করার ম্যাজিক

প্রকাশিতঃ 11:47 am | April 20, 2025

আব্দুল বায়েস:

মেক্সিকো থেকে আমেরিকার আরিজোনা রাজ্যকে আলাদা করার জন্য মাঝখানে একটা দেয়াল দেয়া আছে; যেমন ছিল পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনকে আলাদা করার জন্য ‘বার্লিন ওয়াল’। মেক্সিকো -মার্কিন সেই দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকালে চোখে পড়ে আরিজোনা রাজ্যের নোগালেস শহর। উন্নত দেশের উন্নত শহর। এখানে অধিকাংশ লোকের আর্থসামাজিক অবস্থান আন্তর্জাতিক মাপে বেশ উঁচুতে। সব দিক থেকেই তারা ভালো আছে, ভালো থাকবে, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখবে। উন্নতির উপসর্গ হিসাবে কিছু উপাদান উল্লেখ করা যায় যেমন, সেখানকার মানুষ বেশি দিন বাঁচে; অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে অনেকদূর পর্যন্ত পড়ালেখা করে; অর্জিত সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে নাগরিকদের ভাবতে হয় না; কোথাও বিনিয়োগ করলে মার খাওয়ার চান্স নেই; নেতা পছন্দ না হলে নির্দিষ্ট সময়ের পর নিজেদের পছন্দের লোককে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাতে পারে। আইনের শাসনের কঠোর বাস্তবায়নে মাস্তানি, গুন্ডামি , জবরদখল, গুম, খুন, রাজনৈতিক হয়রানি অনেকটাই সেখানে নিষিদ্ধ ।

বাংলাদেশের দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে উপস্থিত সব জায়গায়, সব খাতে, নগরে ও বন্দরে, এবং সদরে-অন্দরে। অভিযোগ আছে দুর্নীতিবাজদের দাপটে কাঁপছে দেশ– কেউ বা ছিলেছুলে বাকলা রেখে দিয়ে সুদূর কানাডার টরেন্টোর বেগম পাড়ায় পাড়ি দিয়েছে, কেউ মালেশিয়ায় দ্বিতীয় বাড়িতে, কেউ বা ভেতরে থাকছে ‘ম্যানেজ’ করে । এই ম্যানেজ করার ব্যাপার একটা ম্যাজিক এই ভুবনে– ফেলো কড়ি মাখ তেল– যা সবার দক্ষতায় ধরা দেয় না।

অপর দিকে, দেয়ালের ওপরে উঠে দক্ষিণে তাকালে দেখা মেলে মেক্সিকোর শহর সিনোরা। যদিও এটা মেক্সিকোর অপেক্ষাকৃত ধনী একটা এলাকা, যেমন বাংলাদেশের ঢাকা, কিন্তু দেয়ালের উত্তর দিকের চেয়ে এদিকটার মানুষ বেশ গরীব। শুধু যে গরীব তা নয়, ধনী হবার পথেও ব্যাপক আকারে বিপত্তি প্রতি পদে- সংঘবদ্ধ ছিনতাই ও সন্ত্রাস নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার; ব্যবসা বাণিজ্য করা প্রায় অসম্ভব; দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের শেকড় অনেক গভীরে, আইনের শাসনের অভাব ইত্যাদি। যদিও গত ২০ বছর ধরে মেক্সিকোতে গণতন্ত্র আছে , যেমন অভিযোগ বাংলাদেশের ১৫ বছর নিয়ে, কিন্তু মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বেলায় সকলই গড়ল ভেল! ঢাকার গুলশানের মতোই খুব ধনীদের পাশে খুব গরিবের বাস ঐ শহরে ।

দুই.
স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে একই এলাকার দুইটা শহর এমন আলাদা কেন যাদের কিনা ভূমি এক, আবহাওয়া-জলবায়ু এক, অধিকাংশ মানুষের পূর্বপুরুষেরাওতো এক, সাংস্কৃতিকভাবেও তাদের মধ্যে নানা ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, দুই দেশের লোকজন প্রায় একই ধরনের খাবার খায়, ওরা যে-সব গান শুনে; তাও মোটামুটি কাছাকাছি। তাহলে জীবন-যাপনে এত তফাৎ কেনো? কেনো একটা দেশ এতটা ধনী আর অন্য আরেকটা দেশ এতটা দরিদ্র হয় কীভাবে? সমস্যাটা আসলে কী?

এই সমস্যা নিয়ে কাজ করেই এ বছর আমেরিকার তিনজন অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। তারা হলেন, ডেরন আসেমগলু, সায়মন জনসন এবং জেমস রবিনসন। তাদের গবেষণায় দেখা গেল , বিশ্বের ২০% ধনী দেশ দরিদ্র ২০% দেশের চেয়ে অন্তত ৩০ গুণ বেশি ধনী। মজার ব্যাপার হলো, ধনী ও দরিদ্র দেশের আয় বৈষম্য বহুদিন ধরেই স্থির হয়ে আছে অর্থাৎ, দরিদ্র দেশগুলো যদিও ধীরে ধীরে আগাচ্ছে, কিন্তু ততক্ষণে ধনী দেশগুলো আরও ধনী হয়ে যাচ্ছে। ফলে আয় বৈষম্য আর কমছে না। দরিদ্র দেশগুলো ধনী দেশকে কোনোভাবেই ছুঁতে পারছে না। কিন্তু এই আয়-বৈষম্য কেনো ঘটে? এর কোনো প্রতিকার নেই?

এই তিন অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, দুটো জায়গায় পার্থক্যের কারণ ভৌগোলিক অবস্থান বা সংস্কৃতি নয়। ধর্মতো আলোচনাতেই নেই। বরং মূল সমস্যা হলো প্রতষ্ঠানের গুণাগুণ- স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, ব্যাংক, বাজার ব্যবস্থা, মিডিয়া, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সিভিল সোসাইটি ইত্যাদি। দেয়ালের উত্তর পাশে আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মান এতোটাই উঁচুতে যে, সেগুলো তার নাগরিকের শিক্ষা ও পেশা নির্বাচন করতে যথাযথ সুরক্ষা দিতে পারে, যে সুরক্ষা দক্ষিণের মেক্সিকোর সরকারি প্রতিষ্ঠান তার নাগরিকদের দিতে পারে না।

এই তিন অর্থনীতিবিদ এমন এক সময়ে, এমন এক বিষয় নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেলেন, যখন বাংলাদেশ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের সামনে যখন তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরামত করে ঘুরে দাঁড়ানোর সূবর্ণ সুযোগ দুয়ারে উপস্থিত । এন্তার অভিযোগ আছে যে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দেয়ার কারণে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো প্রবলভাবে প্রলম্বিত হচ্ছে ।

তিন.
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থা জানান দেয়, “দেশে বর্তমানে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫টি। বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার, এস আলমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এখন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮টি কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখা (লাইফ সাপোর্ট) হয়েছে। এই ১৮টির মধ্যে ৯টিই মুমূর্ষু। বাকি ৯টি অতিরুগণ, কোনোমতে টিকে আছে। এ ছাড়া রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাব করলে দেশের মোট ২৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থায় খারাপ। কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।” (দৈনিক কালবেলা, ১৩ অক্টোবর ২০২৪)।

দুর্নীতি সম্পর্কিত উপরের ভয়াবহ চিত্রটি নিতান্তই টিপ অফ আইস বার্গ– হিমশৈলের উপরিভাগ মাত্র । তবে “বাংলাদেশে ডুবতে যাওয়া ব্যাংক খাতে আশার আলো দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে টাস্কফোর্স গঠন, কমপক্ষে এক ডজন ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, দখলদারদের হাত থেকে ব্যাংক উদ্ধার এবং কাগুজে নোট ছেপে ব্যাংকের তারল্য সংকট না কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ফল দেবে বলে মনে করছেন তারা” – বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত মন্তব্য ।

মোট কথা টক অব দি কান্ট্রি হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে উপস্থিত সব জায়গায়, সব খাতে, নগরে ও বন্দরে, এবং সদরে-অন্দরে। অভিযোগ আছে দুর্নীতিবাজদের দাপটে কাঁপছে দেশ– কেউ বা ছিলেছুলে বাকলা রেখে দিয়ে সুদূর কানাডার টরেন্টোর বেগম পাড়ায় পাড়ি দিয়েছে, কেউ মালেশিয়ায় দ্বিতীয় বাড়িতে, কেউ বা ভেতরে থাকছে ‘ম্যানেজ’ করে । এই ম্যানেজ করার ব্যাপার একটা ম্যাজিক এই ভুবনে– ফেলো কড়ি মাখ তেল– যা সবার দক্ষতায় ধরা দেয় না। যাই হোক , রাজনীতি , অর্থনীতি এমনকি সমাজনীতির নিয়ন্ত্রক দুর্নীতিবাজ । ব্যাপক দুর্নীতির কারণে জনগণের সেবক হিসেবে সরকারের উপর আস্থা বলতে গেলে এখন শূন্যের কোঠায় । তাই বিগত, বর্তমান কিংবা আগত সরকারের মুখে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের কথা শুনলে অথবা মূল্যস্ফীতি হ্রাস কিংবা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কথা শুনলে ঘোড়াও নাকি হাসতে চায়।

চার.
এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? আপাতত আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে সব দলের সমর্থক বলবেন দায়ী বিদায়ী ফ্যাসিবাদী সরকার। কিন্তু কোনো সরকার এমনি এমনি ফ্যাসিবাদী হয় না; ফ্যাসিবাদী তাকে করে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার এখানেও কথা আছে। প্রতিষ্ঠান যাতে ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম সমর্থন করে সে জন্য, অনেক ক্ষেত্রে, সরকার সংসদে তার বিশাল সংখ্যা গরিষ্ঠতা দিয়ে এমন আইন-কানুন পাস করিয়ে নেয় যা তার একনায়কসুলভ আচরণের পক্ষে সায় দেয় (যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি রহিতকরণ, এমনকি পর পর দুটো নির্বাচনেও না-অবস্থান)।

কয়েক শ’বছর পূর্বে উন্নয়নের জন্য কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সুশাসনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছিলেন এড্যাম স্মিথ ও জন এস মিল। নব্বুইর দশকে ডগলাস নর্থ বললেন, তৃতীয় বিশ্বে ঐতিহাসিক স্থবিরতা এবং সমসাময়িক অনুন্নয়নের জন্য দায়ী কম খরচে চুক্তির কার্যকরিকরণে ব্যর্থতা । অন্য দিকে, ৪০ টি অ-শিল্পায়িত দেশের এক শ বছরের তথ্য নিয়ে এক গবেষক উপসংহার টানলেন এরকম- প্রবৃদ্ধিকে সজোরে সামনে ঠেলে দেয় যে দুই উপাদান তার একটি হল রাজনৈতিক সংগঠন এবং অপরটি সরকারি প্রশাসন । বলাবাহুল্য, পরবর্তীকালে ডগলাস নর্থের পথ অনুসরণ করে অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিজ্ঞানীগণ উন্নয়নের জন্য সুশাসনের গুরুত্ব একনিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে থাকেন। আরও একটা কথা, প্রারম্ভিক পর্যবেক্ষণে দুর্নীতিকে অর্থনীতির চাকার গ্রিজ হিসাবে ধরা হতো কিন্তু ইদানীং সে ধারণা প্রায় অস্তমিত বরং কম দুর্নীতির বিনিময়ে বেশি আয় তত্ত্ব প্রাধান্য পেতে থাকে ।

পাঁচ.
অর্থনীতিবিদ মিনহাজ মাহমুদ ও ইয়াসুকি সাওয়াদার মতে, বাংলাদেশের শাসনের সব চিহ্নই যখন দুর্বল এবং সময়ের আবর্তনে ক্ষেত্রবিশেষ অবনতি ঘটেছে তখন দেশটি অপেক্ষাকৃত উঁচু এবং স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির হার প্রত্যক্ষ করে। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতি ধারণা সূচক’ এর মতে, ইদানীং বাংলাদেশের স্কোর এমনভাবে উন্নীত হয়নি যে কম দুর্নীতি ও বেশি প্রবৃদ্ধির মধ্যকার ইতিবাচক সম্পর্ক পাওয়া যাবে। যখন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের ধারণা বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা ‘হতবুদ্ধিকর’, তখন একই সাথে প্রশ্ন উঠে তাহলে (ক) এমন ক্ষেত্র কি আছে যেখানে শাসন বড় কোনো সমস্যা নয়; (খ) বা শাসনের সূচক একপেশে বিধায় বাস্তব অবস্থা প্রতিফলিত হয় না; (গ) অথবা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি জ্বালানি পেয়েছে এমন উপাদান ও নীতিমালা থেকে যেগুলো অপশাসন- প্রবণ ছিল না।

একটা দেশের প্রাতিষ্ঠানিক গুণ-মান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা দান করে এবং তা ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ধরে রাখার রক্ষাকবচ হিসেবে থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বা তাদের কৃতিত্ব এদের উপর জনগণের আস্থার নিয়ামক হয়ে উঠে যা আবার একটা সমাজে সাধারণ আস্থাকে প্রভাবিত করে থাকে। অন্য কথায়, প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা উঁচু মাত্রায় থাকলে তা নিশ্চিতভাবে ব্যক্তি-ব্যক্তি (ইন্টারপার্সোনাল ট্রাস্ট) আস্থা সৃষ্টিতে অবদান রাখে। ফলে, বিনিময় খরচ হ্রাস পায়, অর্থনীতির উপকার হয়। অনেক গবেষণা বলছে, যেহেতু মানুষের মধ্যে আস্থা সহযোগিতা সৃষ্টে অবদান রাখে, তাই এটা প্রবৃদ্ধির জন্য উপকারী।

ছয়.
সুতরাং, লেট অল রোডস টু রিফরমস– সংস্কার কাজে মন দেয়া দরকার। ঘুণে ধরা প্রতিষ্ঠানের প্রতিকল্প প্রতিস্থাপন কিংবা মোটামুটি চলে এমন প্রতিষ্ঠানের খোলনলচে বদলে দিন বদল করা দরকার। অন্তত বিচারিক, ব্যাংক ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার চা -ই চাই। তবে সব এক সাথে এবং একই সরকার করতে হবে এমন কথা নেই। আমরা এরিজনা চাই, সিনরা নয়।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।