ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় ‘গদি মিডিয়ার’ অপতথ্যের প্রচারে ঘৃণা-ক্ষোভ
প্রকাশিতঃ 11:16 pm | April 20, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
দিনাজপুরের বিরলে পূজা উদযাপন পরিষদের সহ-সভাপতি ভবেশ চন্দ্র রায়ের (৫৫) মৃত্যু নিয়ে ফের অপতথ্য ছড়াচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যম। অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁর মৃত্যু হলেও ভারতীয় ‘গদি মিডিয়া’ বিষয়টিকে প্রচার করেছে ‘সংখ্যালঘু বা হিন্দু হত্যা’। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এপিবিএন, এনডিটিভি, দ্য হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ফাইনেন্সিয়াল এক্সপ্রেস অপহরণ করে নির্মমভাবে নির্যাতন করে খুনের যে অপপ্রচার চালাচ্ছে সেটিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার সকল ধর্মের নাগরিকদের সমান অধিকার নিশ্চিত করে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় ভারত সরকারের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন।
ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শরীরে কোনো দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবুও মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে ভিসেরা বিশ্লেষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ এদিকে, বাংলাদেশে সকল পক্ষের সম্মিলিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে অস্থিতিশীল করে তুলতে ভারতীয় মিডিয়ার যথেচ্চারের বিরুদ্ধে সরব দেশের মানুষ। মিথ্যা ভাষ্য ও বিকৃত তথ্য প্রচার করে তাঁরা পুনরায় অযৌক্তিক ও অপেশাদার আচরণের পরিচয় দিয়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে বারবার নিজেদের জাহির করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম।’
অপরদিকে, বাংলাদেশের প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার ভবেশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে নিজেদের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে সরে এসেছে। তাঁরা নিউজটি প্রত্যাহার করে দু:খ প্রকাশ করেছে। এই বিষয়টিকে হত্যা বলতে নারাজ নিহতের পরিবারের সদস্যরাও। তবে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর পাঁয়তারা করছে বলেও দেশের বিভিন্ন পরিমণ্ডল থেকে অভিযোগ উঠেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ভারতীয় গণমাধ্যমের সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি বাড়বাড়ন্ত হয়ে ওঠে। মার্চে এমন ২৬টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে অর্ধেক ঘটনাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই মাসের শুরুতে রিউমর স্ক্যানার তাদের ওয়েব সাইটে এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানায়।
অপপ্রচারের বিপরীতে ভবেশের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ
নিহত ভবেশ চন্দ্র রায় বিরল উপজেলার শহরগ্রাম ইউপির বাসুদেবপুর গ্রামের মৃত তারকানন্দ রায়ের ছেলে। তিনি পেশায় কৃষক ছিলেন। তাঁর পারিবারিক সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার দিকে ভবেশ চন্দ্র রায়ের মোবাইলে একটি ফোন আসে। এরপর তিনি বাড়িতে আছেন জানালে কিছুক্ষণ পর দুটি মোটরসাইকেলে তাঁর চারজন বন্ধু এসে তাকে নিয়ে যায়। তবে এ সময় তাকে কোনও জোরজবরদস্তি করা হয়নি। স্বেচ্ছায় মোটরসাইকেলে করে তাদের সঙ্গে গেছেন তিনি। রাত ১০টার দিকে মোবাইল ফোনে পরিবারকে জানানো হয় পান-বিড়ি খাওয়ার পর ভবেশ চন্দ্র রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে একটি ভ্যানযোগে বাড়ির পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়ী হাটে পাঠানো হয়েছে। পরে পরিবারের সদস্যরা ফুলবাড়ি হাটে গিয়ে ভবেশ চন্দ্র রায়কে অচেতন অবস্থায় পান।
ভবেশ চন্দ্র রায়কে যখন অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় তখন স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসক কৃষ্ণ কান্ত তার বিপি মাপেন। কৃষ্ণ কান্ত রায় জানান, অসুস্থতার সময় তার চোখ-মুখ বন্ধ ছিল, মুখে বমি ছিল। মাপা হলে তার রক্তচাপ ছিল উপরে ৭০ এবং নিচে নীল। পরে তিনি ভবেশ চন্দ্র রায়কে মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ভবেশ চন্দ্র রায়কে মৃত ঘোষণা করেন। রাতেই পুলিশ নিহতের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) রাত ১১টার দিকে ভবেশ চন্দ্র রায়ের মরদেহ দাহ্য করা হয়। রবিবার (২০ এপ্রিল) ছিল তাঁর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। তবে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা কিংবা অপমৃত্যু মামলা দায়ের করার বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি তাঁর পরিবার।
নিহতের ছেলে স্বপন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, তার বাবাকে চার বন্ধু এসে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে গেছে। পরে রাতে মোবাইলে জানানো হয় যে তার বাবা অসুস্থ। পরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। পারিবারিকভাবে আলোচনা করে কী করা যায় সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তবে তাঁর বাবাকে হত্যার যে খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেই সংক্রান্ত কোন তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে নেই। কোন তথ্য-প্রমাণ ছাড়া তিনি এটিকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে চালিয়ে দিতে আপত্তি প্রকাশ করেন। একই রকম তথ্য জানান ভবেশের স্ত্রী সান্ত্বনা রাণীও।
স্থানীয় নাড়াবাড়ি বাজারের দুধ হাটিতে চায়ের দোকান করেন অহিদুল। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁর দোকানে রতন, আতিক, রুবেল, মান্না ও ভবেশ চন্দ্র একসঙ্গে চা পান করেন। এ সময় তাঁরা বেশ স্বাভাবিক ছিল। এ সময় তাদের কাউকে শারীরিকভাবে অসুস্থ মনে হয়নি। চা খেয়ে পাশের দোকানে তাঁরা পান ও সিগারেট খায়। কিছুক্ষণ পর হাটখোলার একটি ঘরের খুঁটিতে হেলান দেন ভবেশ। পরে হয়তো মাথা ঘুরে যায় এবং সেখানে বসে পড়ে।
অহিদুলের পাশের পান-বিড়ির দোকানি মতিবর রহমান জানান, ভবেশ আমার দোকান থেকে পান খাওয়ার পর এক পর্যায়ে হাটখোলার একটি ঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়েন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা লোকজন তাকে ধরাধরি করে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের দোকানে নিয়ে যায়। পল্লী চিকিৎসক তাঁর প্রেসার মাপেন। তিনি দেখেন তাঁর প্রেসার নীল হয়ে গেছে। পরে তাকে ভ্যান করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে তাঁর পরিবার বিষয়টি থানা পুলিশকে জানায়।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, বন্ধুদের সঙ্গে অতিরিক্ত মদ্যপানেই ভবেশের মৃত্যু হতে পারে। গ্রামে এই ধরনের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সত্যাসত্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুলিশের তদন্তে পুরো রহস্য উদঘাটিত হতে পারে।
এ বিষয়ে বিরল উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুবল চন্দ্র রায় জানান, ভবেশ চন্দ্র রায় বিরল উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার মৃত্যুর বিষয় নিয়ে পরিবার থেকে কোনও অভিযোগ দেওয়া হয়নি।
একই বিষয়ে রোববার (২০ এপ্রিল) দিনাজপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফাত হুসাইনের সঙ্গে কথা বলে কালের আলো। তিনি ঘটনার সারসংক্ষেপ জানিয়ে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে প্রতিবেশী যুবক রতন, আখতারুল ইসলাম, রুবেল ইসলাম ও মুন্নার সঙ্গে দুটি মোটরসাইকেলে করে ভবেশ নাড়াবাড়ি হাটে যায়। তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলেও তারা নিয়মিত একসঙ্গে আড্ডা দিতো। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাজারে চা খেয়ে পান ও সিগারেট খায়। এরপর মাথা ঘুরে ভবেশ বসে পড়েন। খয়ের, চুন ও কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খেয়েছিল। এ সময় দোকানের একটি খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়েন। পরে সেখান থেকে ধরাধরি করে পল্লিচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁর পরামর্শে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
সুরতহাল প্রতিবেদনে শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি
বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস সবুর জানান, এই ঘটনায় নিহতের পরিবারকে অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। আমরা ঘটনার রাতেই নিহতের সুরতহাল প্রতিবেদন করেছি। তবে তার শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন জন্য পাওয়া যায়নি। এরপর আমরা নিজ উদ্যোগেই নিহতের মরদেহের ময়নাতদন্তের পদক্ষেপ গ্রহণ করি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসলে বিষয়টি স্পষ্ট করে জানা যাবে।’ সুরতহাল প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. গোলাম রব্বানী।
দিনাজপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফাত হুসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই নিহতের ঘটনায় কেউ কোন মামলা করতে আসেনি, অভিযোগও দেয়নি। ময়নাতদন্ত হয়েছে, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসলে বোঝা যাবে। আমাদের ওপরে কোনও চাপ নেই। সঠিক তথ্য যেটি আপনাদের জানালাম। যাদের সঙ্গে গিয়েছে তাদের সঙ্গে থাকা অবস্থাতেই সে অসুস্থ হয়েছে। এরপর তারাই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেছে, পরিবারকে জানিয়েছে। এরপর গুরুতর অবস্থা হলে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। পরিবার অভিযোগ তুলেছে, এজন্য আমরা সুরতহাল প্রতিবেদন করেছি, ময়নাতদন্ত করেছি। আমরা তদন্ত অব্যাহত রেখেছি। যেহেতু তার মৃত্যু নিয়ে একটি বিষয় এসেছে। আমাদের কর্মকর্তারা এবং থানা পুলিশ তদন্ত করছে যে কোনও ঘটনা আছে না। কোনও ঘটনা থাকলে আমাদের কাছে আসবে এবং আমরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে অন্য কোনও ঘটনার তথ্য নাই, তদন্তেও আসেনি। আমি থানাকে বলে রেখেছি, পরিবার যদি মামলা করতে চায় তাহলে মামলা করবে। যদি তদন্তে হত্যার ঘটনা থাকে তাহলে সেভাবেই তদন্ত করে হত্যাকারীদের বের করবো।’
ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা বিব্রতকর। ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। যদি কোনও ঘটনা ঘটে থাকে, ঘটনা যদি প্রকৃত না ঘটে থাকে সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে কোনও কিছু মিডিয়াতে বলা ঠিক না।’
ডেইলি স্টারের সংবাদ প্রত্যাহার
গত ১৮ এপ্রিল দিনাজপুরে অপহরণের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাকে পিটিয়ে হত্যা’ শীর্ষক একটি খবর প্রকাশ করে দেশের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার। কিন্তু গত রোববার (২০ এপ্রিল) রাত ৮ টা ২৬ মিনিটে ‘দিনাজপুরে মৃত্যু নিয়ে সংবাদ প্রত্যাহার করলো ডেইলি স্টার’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ দু:খ প্রকাশ করে। যারা আগের ভুল সংবাদটির রেফারেন্সে এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করছেন তাদেরকেও এটিকে রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ না করতেও অনুরোধ জানায় এই ইংরেজি দৈনিকটি।
কালের আলো/আরআই/এমকে