পানিতে তীব্র দুর্গন্ধ থাকলেও দায় নিচ্ছে না ওয়াসা

প্রকাশিতঃ 10:48 am | April 24, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু সেই পানিই দূষিত হলে হতে পারে নানা রোগের কারণ। ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির গুণমান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বাসিন্দারা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। পানিতে তীব্র দুর্গন্ধ, কালচে বা হলদে বর্ণ, ময়লা এবং কখনো কখনো পোকামাকড় পর্যন্ত পাওয়া যায়। এই পানি পান করা কথা তো দূরে থাক, রান্না, গোসল কিংবা ধোয়ামোছার মতো সাধারণ কাজেও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ।

গত কিছুদিন যাবত আবার ট্যাপের পানিতে ছোট ছোট লার্ভার মতো পোকা ও কেঁচো পাওয়ারও অভিযোগ ওঠেছে। রাজধানীর মিরপুর, খিলগাঁও, বনশ্রী, কল্যাণপুর, শেওড়াপাড়া, মহাখালী, বাড্ডা, বাংলামটর, তেজগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, মুগদা, যাত্রাবাড়ী, বাসাবো, জুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা করেছেন এমন সব অভিযোগ। তাঁরা ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কাছে এমন অভিযোগ করলেও তাঁরা সেটি মানতে নারাজ।

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার ৮ নম্বর সড়কের বাসিন্দা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, ‘১৫ থেকে ২০ দিন ধরে পানির সঙ্গে লাল কেঁচো ও সাদা লার্ভার মতো পোকা আসছে। সম্প্রতি দুইবার বাসার দুটি ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করানো হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে পানি কিনে খাচ্ছি।’ বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা মামুন খান জানান, ‘আমাদের আশপাশের প্রায় প্রতিটি বাসাতেই পানিতে ছোট ছোট কেঁচো পাওয়া গেছে। আমরা ওয়াসাকে অভিযোগ জানিয়েছি; কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।’ একই অভিযোগ করেন কল্যাণপুরের রোড-১৩ এলাকার বাসিন্দা নঈমুর রহমানও।

তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আমাদের পরিবারের সবাই চর্মরোগে ভুগছেন। ওয়াসার পানি ভর্তি ছিল পোকায়। অসহ্য চুলকানি হতো। বাধ্য হয়ে বোতলের পানি কিনে খাচ্ছি। আমাদের পানির ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করেও সমস্যার সমাধান হয়নি।’ নিউইস্কাটনের বাসিন্দা আবুল হাসান বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম ময়লা, পরে দেখি পানিতে ছোট ছোট পোকা আর কেঁচো। এই পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। সমস্যাটা দেখার পর বাড়িওয়ালাকে জানিয়েছিলাম। ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার পরও পোকা আসা বন্ধ হয়নি। ওয়াসাতেও অভিযোগ দিয়েছি; কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।’

দেলোয়ার হোসেন নামের আরেকজন ফেসবুকে লিখেছেন, রাজধানীতে ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ ও পোকা, বাসিন্দাদের ভোগান্তি চরমে। কল ছাড়লেই বের হচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি ও পোকা। এ পানি পান না করলেও বাধ্য হয়ে বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করছে মানুষ। বাসা-বাড়ির পানির ট্যাংক পরিষ্কার করেও সমাধান মিলছে না। সবাই বলছে পানিতে পোকামাকড়ের উৎস ওয়াসার সাপ্লাই পাইপ।

আফতাবনগরের বাসিন্দা এএনএম মাসুম ফেসবুকে লেখেন, গোসল আর রান্না-বান্নার পানিতে কিলবিল করছে পোকা! এ সমস্যা ফেইস করছি অনেকদিন ধরে। কিন্তু ওয়াসার পক্ষ থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছি। খিলগাঁওয়ের মেহেদি হাসান রানা ও মগবাজারের তোফায়েলও একই ধরনের অভিযোগ করেছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপলাইনে পোকা পাওয়া মানেই লাইনের কোথাও ফাটল বা রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি আছে। পোকাযুক্ত পানি ব্যবহার করলে ত্বকে সংক্রমণ, পেটের অসুখসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শিশুরা পানি খেলে মারাত্মক অসুখ হতে পারে। অনতিবিলম্বে সমস্যার সমাধান জরুরি এবং ওয়াসা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।

তবে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) এ কে এম শহীদ উদ্দিন বলেন, ‘গত কয়েকদিনে কল্যাণপুর, মগবাজার, মধুবাগ, আরকে মিশন রোড থেকে পানির সমস্যা নিয়ে অন্তত ৪০টি অভিযোগ পেয়েছি। প্রতিটি জায়গায় আমাদের লোক পাঠিয়ে চেক করিয়েছি; কিন্তু সরবরাহ লাইনের পানিতে কোনো সমস্যা পাইনি। আমাদের পরিশোধিত পানিতে ক্লোরিন মিক্স করে পাঠানো হয়। ফলে এমন পোকা থাকলেও তা মারা যাওয়ার কথা।’

তিনি বলেন, ‘ওয়াসার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলোর পানি নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। কোথাও পানিতে সমস্যা পাইনি। ঢাকায় বর্তমানে প্রতিদিন ২৮৫ থেকে ২৯০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছি, যার মাত্র কয়েকটি স্থানে অভিযোগ পাচ্ছি। এসবের অধিকাংশই বাড়িগুলোর ওয়াটার রিজার্ভার পরিষ্কার করে না-এটাই সমস্যা।’

মাঠপর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে ওয়াসার জোনাল অফিসের প্রকৌশলী বদিউল আলম বলেন, আমরা অভিযোগ পেয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গিয়েছি এবং ওয়াসার পাইপলাইনের পানি স্বচ্ছ ও জীবাণুমুক্ত পেয়েছি। সম্ভবত বাড়ির ট্যাংক পরিষ্কার না করার কারণে পোকা জন্মেছে।

সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসা এ বিষয়ে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। সেখানে গ্রাহকদের তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ও ওভারহেড রিজার্ভার নিয়মিত পরিষ্কার রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ওয়াসা জানিয়েছে, তাদের সরবরাহকৃত পানিতে কোনো পোকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি এবং ল্যাবে পরীক্ষায় কোনো জীবাণুও মেলেনি। ওয়াসা ৭৪ ভাগ পানি গভীর নলকূপ থেকে ও ৩৬ ভাগ নদীর পানি পরিশোধন করে সরবরাহ করে এবং সরবরাহ নেটওয়ার্কে পর্যাপ্ত ক্লোরিন থাকে। পানিসংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগে ১৬১৬২ নম্বরে কল করতে বলা হয়েছে।

কালের আলো/আরআই/এমএসএএকে