১১ বছরে হয়নি ডায়াবেটিস নীতি

প্রকাশিতঃ 10:57 pm | October 07, 2017

২০০৬ সালে ২০ ডিসেম্বর ‘ইউএন রেজুলেশন ৬১/২২৫’ শীর্ষক ঘোষণাপত্রে জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দেয়া হয়। আট বছর পর ২০১৪ সালে ‘জাতীয় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ নীতিমালা’র খসড়া করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরপর তিন বছর পার হলেও খসড়াটির আর কোনো খবর নেই। এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতির খবরও জানাতে পারলেন না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

জাতিসংঘের রেজুলেশন গ্রহণে ১১ বছর পার হলেও জাতীয় নীতিমালাটি চূড়ান্ত হয়নি। দেশে ডায়াবেটিসের ক্রমবর্ধমান বিস্তারের মধ্যে রোগটি প্রতিরোধে দিক-নির্দেশনা সম্বলিত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে জাতীয় নীতিমালা করার বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছিল। এরপর আমরা একটা খসড়া করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এটা চূড়ান্ত করতে কোনো উদ্যোগ দেখলাম না।’

বাংলাদেশে এখন আনুমানিক ৮০ লাখের বেশি ডায়াবেটিসের রোগী আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দিন দিন তো এ রোগের ব্যাপকতা বেড়েই চলছে।’

অধ্যাপক এ কে আজাদ আরও বলেন, ‘যে খসড়াটি আমরা দিয়েছিলাম তা বাস্তবায়নের সঙ্গে তো সরকারের তেমন কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতাও নেই। নীতিমালাটি করতে তেমন টাকা খরচ হবে না। কিন্তু এটা জরুরি। সরকার এটা কেন চূড়ান্ত করছে না তা আমরা বুঝতে পারছি না!’

বাডাস সভাপতি বলেন, ‘২০০৬ সালে ইউএন ডে ফর ডায়াবেটিস যখন হল, বাংলাদেশ সরকার তো তখন আমাদের অনুরোধেই জাতিসংঘে প্রেজেন্টেশন দিয়েছিল। ওই সময় যে রেজুলেশন হল তাতে বলা হয়, প্রত্যেক দেশ একটা জাতীয় নীতিমালা করবে। এটা তো একটা মোরাল অবলিগেশন (নৈতিক বাধ্যবাধকতা)। সরকারের তো এটা করা উচিত।’

দুই বিভাগ হওয়ার আগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মো. সিরাজুল ইসলাম। গত ১৬ মার্চ মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন ‘স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ’, ও ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ’ করা হয়।

পরে ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ’ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পান মো. সিরাজুল ইসলাম। অপরদিকে ‘স্বাস্থ্য সেবা’ বিভাগের সচিব হন মো. সিরাজুল হক খান।

ডায়াবেটিসের নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এখন আর ওই বিভাগের দায়িত্বে নেই। অন্য একজন সচিব এটা দেখছেন। তবে যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন নীতিমালার বিষয়টি আমার নজরে আসেনি, তখন এটা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি।’

মো. সিরাজুল হক খানের কাছে ডায়াবেটিস নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এই বিভাগের দায়িত্ব পেয়েছি বেশিদিন হয়নি। নীতিমালার বিষয়টি আমি এখনও জানি না। তবে আমি এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করতে উদ্যোগ নেব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রকৃতি থেকে যতই দূরে সরে যাচ্ছি, বিলাসী জীবন-যাপন করছি, নানা রকম ভাজাপোড়া ফ্যাট খাচ্ছি, নগরজীবী হয়ে যাচ্ছি। ফলে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা সবাই ধনী হয়ে যাচ্ছি। গ্রামে গেলাম, দেখলাম কেউ আর হাঁটে না। পাকা রাস্তা হয়ে গেছে, সবাই ভ্যানে চড়ে চলাচল করে। মানুষের অভ্যাসের কারণে ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। এটা প্রতিরোধে নীতিমালার প্রয়োজন আছে।’

শরীরের অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিনের সহায়তায় রক্তের গ্লুকোজ (শর্করা) শক্তিতে পরিণত হয়। অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে বা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে রোগ হয় তা হলো ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ। ইনসুলিনের অভাবে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং এটা প্রশ্রাবের মাধ্যমে শীরর থেকে বের হয়ে যায়। রক্তে শর্করার আধিক্য বা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে হৃদপিণ্ড, কিডনি, চোখ, দাঁতসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির খসড়া প্রস্তুতের সংঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পৃথিবী জুড়েই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, বর্তমানে মহামারি আকারে এর বিস্তার ঘটছে। চার ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে। টাইপ-১, টাইপ-২, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে খুব কম বয়সে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার আতঙ্কজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীদের ৯৫ ভাগ টাইপ-২ এ আক্রান্ত। এটা কমানো সম্ভব।

তারা জানান, ডায়াবেটিস আক্রান্তদের হার বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ অতিদ্রুত নগরায়ন। দ্রুত নগরায়নের ফলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতিও বদলে যাচ্ছে। শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, চর্বি ও শর্করা সমৃদ্ধ খাদ্র গ্রহণ, অতিরিক্ত খাওয়া, ক্যালরিযুক্ত ফাস্ট ফুড ও কোমল পানীয় গ্রহণের অভ্যাস গড়ে ওঠায় মানুষের মধ্যে মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর এ ধরনের লোকদেরই ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাধারণত শরীর মোটা হয়ে গেলে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যায়। এ অবস্থায় রোগ সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডায়াবেটিস বিস্তারের কারণ এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে রোগটি প্রতিরোধে স্ব-উদ্যোগী করে তুলতে হবে। গ্রাম ও শহরের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জীবন-যাপন পদ্ধতির প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন এনে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। ডায়াবেটিসের বিষয়ে আগাম সতর্কতা অবলম্বনের সুবিধার্থে নিয়মিত রক্তসহ আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই অবস্থার উন্নতি হবে। আর আইনগত কাঠামো বা নীতিমালা ছাড়া এ কাজগুলো করা যাবে না।